সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অবাক পৃথিবী (1B)

মা ঘরে নিয়ে গিয়ে পিকলুকে একটা ফানেলের জামা আর হাফ হাত সোয়েটার পরিয়ে দিল। মা কে আজ একদম ভালো লাগছে না, কিন্তু সেটা বোঝাবার সাহস নেই।  দিদিকে দলে পাওয়া যাবে না এসব ব্যাপারে।  লড়াইটা তার একার।   
পিকলু আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। অনেক মানুষই ক্ষুদিরামদের বাড়ির কোণে হারিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে নাক বরাবর গেলে বিলুদাদের ঘর। একটু এগিয়ে ঢাল বেয়ে নামলেই খাল। 
বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে সামনের শিবমন্দিরের চাতালে কয়েকজন বন্ধু বসে।  একবার ডেকে কথা বলতে ইচ্ছে করল, কিন্তু মা নিশ্চয় খুশি হবে না তাতে।  ক্ষুদিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না,  সে নিশ্চয় ভোর থেকেই খালপাড়ে।
পিকলুর বন্ধুদের যেখানে খুশি যেতে কোনো বাধা নেই, কেবল তার বেলাতেই সীমানা নির্দিষ্ট করে দেয়া। পিকলুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে দুঃখে। 
সে আজকে লুচি খাবে না। অংকের খাতায় কাটাকুটি খেলবে, ইস্কুলের বই মিকি মাউসের স্টিকার লাগিয়ে নষ্ট করে দেবে। মা চেষ্টা করেও তাকে বর্ণপরিচয় থেকে কঠিন বানান লেখাতে পারবে না। বাবা হাতের লেখা দিলে খুব তাড়াতাড়ি লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলবে আজ। 
পিকলু মাথা গোঁজ করে ঠাকুমাদের ঘরের দিকে জোরে পা চালালো। রান্নাঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।  সেখানে মা একটা পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কড়াইয়ে লুচি ছাড়তে ব্যস্ত।  মুখটা তার বেশ থমথমে। হাতে খুন্তি নিয়ে মাকে যেন দূর্গা ঠাকুরের মত দেখাচ্ছে। পিকলু এখনো দাঁত মাজেনি। সে ব্যাপারে মায়ের কোনো খেয়াল নেই যেন। পিকলুর তাতে খারাপ লাগার কথা নয়, আজকে সে রাগ করেছে।
ঘরের কোণে কালো ডেও পিঁপড়েদের লম্বা লাইন একটু সময় নিয়েই ভাঙলো সে। বিশৃঙ্খল পিঁপড়েরা এখন রান্নাঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে।  ওদের মধ্যে হুমদো মস্তানগুলো একটা খালি পা পেলেই দাঁড়া বসিয়ে দেবে। 
মা সেখানেও কোনো বাধা দিল না। সোয়েটারটা না পরে বাইরে বেরোনো ঠিক হয়নি।  নাকি পুতুলদির সাথে যাবার কথায় মা রাগ করেছে? কিন্তু সেটা মাকে জিজ্ঞাসা করবে না আজ। কাল করবে।  
পিকলু রান্নাঘর টপকে বড় দালানের দিকে পা বাড়ালো।  ঠাকুমাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি তাদের ঘরে বোধয় কেউ নেই।  ঠাকুমাদের রান্নাঘরের জানালায় মুখ লাগিয়েও কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না।  তাহলে কি ঠাকুমাও উল্টো বাস দেখতে চলে গেল? তাকে না নিয়েই?  বাথরুমের দরজাটাও তো খোলা।  
ঠাকুমার কয়েকটিমাত্র যাবার জায়গা।  পিকলু ঠিক তাকে পেয়ে গেল পেছনদিকের পুকুর ঘাটে গালে হাত দিয়ে বসে।  পিকলু গা ঘেঁষে বসে পড়লো।  
তাকে দেখে ফিক করে হেসে উঠলো ঠাকুমা। "এতো সকাল সকাল উঠে পড়েছো সোনা?"
"জানো ঠাকমা, ক্ষুদিদের খালপারে একটা বাস উল্টে গেছে?"
"জানিতো , কি দুঃখের একটা ব্যাপার।"
পিকলুর দুঃখ বেড়ে গেলো তাতে। ঠাকুমার তো জানার কথা নয়। সে তো ঠাকুমা। তাকে সব খবর তো পিকলুই এনে দেবে। "পল্টন কাকু কোথায়? সুমিদি? দাদু এসেছে কাল?"
"পল্টন আর দাদু গেছে খালপাড়ে, সুমি পড়তে গেছে। "
"তোমায় ওরা নিয়ে যায় নি দেখতে?"
"না তো, আমায় তো কেউ কোথাও নিয়ে যায় না সোনা।"
"আমি নিয়ে যাবো, চলো। মাকে বলে দাও তাহলে।"
আবার ঠাকুমা ফিক করে হেসে উঠলো। ঠাকুমাকে হাসলে খুব ভালো লাগে পিকলুর। "এসব দেখলে রাতে ঘুম আসবে না যে সোনা। সে যে বীভৎস এক দৃশ্য। তাছাড়া ..."
পিকলু ঠাকুমার কথায় খুব মুষড়ে পড়লেও, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। দুজনের মধ্যে ইচ্ছের লড়াইয়ে আজ পর্যন্ত সে হারেনি।  একটু বুদ্ধি করে কথা বললেই ঠাকুমা হার মেনে নেয়।  ঠাকুমাকে খালপাড়ে নিয়ে যাওয়াটা খুব একটা দুঃসাদ্ধ ব্যাপার হবার কথা নয়।  আবার ঠাকুমা সাথে থাকলে, মা ও কিছু বলতে পারবে না। মা ঠাকুমার সব কথা শোনে।      
"তাছাড়া ... কি তাছাড়া?"
"ও কিছু না।”
“বল না।  বল আমায়, আমি তোমায় এক্ষুনি একটা বুদ্ধি দিচ্ছি।”     
“তা ঠিক। তোমার বুদ্ধিতেই তো আমি চলি।  ভাবছিলাম শনিবার করে তো ওই সময়টাতেই দাদু বাড়ি ফেরে। যদি একটু দেরি হত, যদি আগের দুটো বাস ছেড়ে দিতে হত ..."
একেবারে নতুন এক সম্ভাবনায় পিকলুর চোখ চিক চিক করে ওঠে। "তাহলে কি হতো ঠাকমা? দাদু কি ওই বাসের সাথে জলে ডুবে যেত?”
ঠাকুমা চমকে ওঠে। "সকাল সকাল এসব বাজে কথা বলতে নেই পিকলু। কি আবার হত, তোমার জন্য আনা মোরোব্বাগুলো জলে ভিজে যেতো একটু। দাঁত মেজেছো? যাও দাঁত মেজে আসো, মোরব্বা দিচ্ছি। ছেঁড়া পরোটা এনেছে পল্টনকাকু। খাবে আমার সাথে? চলো, আজকে তুমি আর আমি খাবো একসাথে।”
বাস দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা আপাততঃ স্থগিত রাখতে হলো। ছেঁড়া পরোটা তার এক বিশেষ দুর্বলতা।  পিকলু বড় হলে একটা ছেঁড়া পরোটার দোকান দেবে। ঠাকুমার সাথে এব্যাপারে তার পরিকল্পনা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।  লুচি না খেয়ে মায়ের প্রতি রাগ দেখানোটাও হবে এক সাথে। 
পিকলু দালান ডিঙিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ালো। 
পিকলুর নিজের ঠাকুমার সাথে দেখা হয় বছরে এক বার। এক রাত্রি ট্রেনে চেপে  যেতে হয় গয়াতে ঠাকুমার বাড়ি।  ট্রেনের জানালার সামনে দিদির সাথে ঠাসাঠাসি করে বসতে ভালো লাগলেও, ঠাকুমার বাড়ি পৌছিয়ে আর ভালো লাগে না।  ঘরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। 
জ্ঞান হওয়া অবধি সে ইন্দুমতিকেই ঠাকুমা বলে, নিহাররঞ্জনকে দাদু। ইন্দুমতীর মাথার কিছু চুলে পাক ধরেছে, আর নিহাররঞ্জনের সামনের একটা দাঁত পরে গেছে। ঠাকুমা দাদুরা এরকমই হয়। তার গয়ার ঠাকুমা চাঁদবুড়িদের মত থুত্থুড়ে। পিকলুর বেশি বয়সের ঠাকুমাদের পছন্দ হয় না।  
পল্টনকে কাকু আর সুমিকে দিদি বললেও, তারা ভাই বোন। কাকু দিদির থেকে অনেক ছোট, নয় ক্লাসে পরে, সুমিদি সবে স্কুলের লালপেড়ে শাড়ি ছেড়ে কলেজে রঙিন শাড়ী পরে যাবার অধিকার পেয়েছে। মাধ্যমিক পাশ করায় পিকলুর বাবা সুমিদিকে একটা হাতঘড়ি দিয়েছে। সেটার প্রতি পিঙ্কির খুব লোভ। সন্ধেবেলায় ঘড়িটার  চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে জুলজুল চোখে চেয়ে থাকে সে ঘড়িটার প্রতি। সুমিদির বিয়ে হয়ে গেলে এই ঘড়িটা পিঙ্কিরই পাবার কথা।  পিঙ্কির বিয়ে হলে ঘড়িটা পাবে পিকলুর বৌ।  পিকলু কোনোদিন বিয়ে করবে না যদিও,  সুমিদির চাইনিজ কলমগুলোয় কালি ভরতে পারলেই সে  কৃতার্থ। 
সুমিদি পিকলুর বাবাকে দাদা ডাকে, অথচ তাকে পিসি বললে চলবে না। পল্টনকে আবার দাদা ডাকলে রেগে যায়। সে পল্টনকাকু। 
একই ঘরে কাকু আলাদা শোয় একটা ক্যাম্পখাটে। তার মাথার ওপর দেয়ালে মিঠুনের একটা পোস্টার, নীচে ইংরেজিতে লেখা ডিস্কো ডান্সার। পাশের দেয়ালে মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার। 
পাড়ার সব দাদারা এখানে মিঠুনের মতো চুল রাখে, চোঙা প্যান্ট পরে। শীতকাল বলে এখন তারা জামার ওপর ফ্রকের মতো দেখতে পঞ্চো পরে থাকে। সবাই একটা ছুতো খোঁজে টেপ রেকর্ডারে  ক্যাসেট চালিয়ে নাচ দেখাবার। অনেকেই সিনেমার নায়ক হবার স্বপ্ন দেখে।  
প্রায় সবাই নাচের নামে ব্যাঙের মত লাফায়, অথবা গৌড় নিতাই হয়ে শুন্যে হাত ছোঁড়ে।  তবে কয়েকজন সিনেমার হিরোদের থেকেও ভালো নাচতে পারে।  পল্টনকাকুর নাচ দেখতে যেমন ভীড় জমে যায়। অনেক দর্শক হয়ে গেলে  পল্টনকাকু হঠাৎ করে নাচ থামিয়ে এক কাঁধ হালকা ওপরে তুলে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। তখন পিকলুরা তার পেছন পেছন দৌড়ায়। ঠিকমত আব্দার করতে পারলে পল্টনকাকু হালকা মুনওয়াক করতে করতে গেট খুলে পাঁচিলের আড়ালে হারিয়ে যায়। বন্ধুদের ছানাবড়া চোখ দেখে পিকলুর বেশ মজা লাগে। সে মাঝেমধ্যেই পল্টনকাকুকে আয়নার সামনে মুনওয়াকিং প্র্যাক্টিস করতে দেখে।
পল্টনকাকুর বন্ধু শম্ভুদা আবার লোক না জমলে নাচবে না। মাইকেল জ্যাকসনের সত্যিকারের নাচ খুব কম লোকেরাই দেখেছে এখানে। পল্টনকাকু আর তার বন্ধুবান্ধবরা একবার সিনেমা হলে টিকিট কেটে সে নৃত্য দেখে এসেছে। সিনেমার মত এক ঘন্টা কেবল মাইকেল জ্যাকসনের নাচাগানা। তারপর থেকে তারা চীনাদের জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। পুজোয়
বিশেষ অর্ডার দিয়ে প্যান্ট তৈরী করে পল্টনকাকু, শম্ভুদা, স্বরুপদারা বেশ কয়েকদিন বিয়ে, পুজো, অন্নপ্রাশনে নাচানাচি করলো। নস্করকাকুর দাদুর শতবর্ষের জন্মদিনে ব্রেক ডান্সের উৎসব চলাকালিন বুড়ো মারা যাওয়ায় এখন আর তেমন ভাবে স্বতঃস্ফূর্ত নাচ হচ্ছে না। পাড়ার বয়স্করা সুযোগ পেয়ে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। একটা চাপা উত্তেজনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে মিটিং মিছিলে দুটি প্রজন্ম মুখোমুখি হলে।  
থ্রিলার ক্যাসেটটা এখানে খুব জনপ্রিয়। একটি কথাও কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু ছেলেরা উত্তাল কোমর দোলায়। শম্ভুদা তাদেরই মধ্যে অদ্ভুত শরীর বেঁকিয়ে দুমড়িয়ে ব্রেকড্যান্স করে।  সেটাই নাকি জ্যাকসন নাচ। এমনকি মাইকেল  যদি একবার শিবতলা ঘুরে যেত, তাহলে শম্ভুর থেকে কিছু জ্যাকসনি ব্রেকড্যান্স শিখে নিতে পারত, এমনও কেউ কেউ দাবি করে।  তবে পুজোর ভাসানের ভীড় না হলে শম্ভুদার নাচ দেখা মুশকিল। সত্যিকারের শিল্পীরা অমনি নাচ বললেই নাচে না।
মিঠুনের 'ডান্স ডান্স' সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছে। ক্লাবের থেকে লাইন টেনে শিবমন্দিরের  চাতালে বক্স বাজিয়ে প্রায়শই নৃত্যের আসর বসে। সুযোগ পেলে পিকলুর বন্ধুরাও নাচে, কিন্তু মা তাকে কিছুতেই তাদের সাথে নাচতে দেবে না।  ক্ষুদিরামদের যেহেতু কিছুতেই কোন বাধা নেই, তারা পালা করে ইতিমধ্যেই সিনেমাটা দেখে এসেছে সিনেমাহলের একেবারে সামনের সারিতে বসে। 
পিকলু কথা শোনে বলে বলে মা একদিন সিনেমাটা দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে। রোজ সকালে মেজদা বা ছোটুদাকে মা পাঠায় টিকিটের লাইনে। কিন্তু টিকিট পাওয়ার থেকে লটারির প্রথম পুরস্কার পাওয়া সহজ। কাউন্টার খুলতে না খুলতে টিকিটগুলো বিক্রি হয়ে যায়। রোজই প্রায় কাউন্টারের সামনে ভাংচুর হয়। তখন ছোট্ট ঘুলঘুলি বন্ধ করে দিয়ে টিকিটওলা উধাও। এর পরেই কিছু লোকের হাতে দেখতে পাওয়া যায় প্রচুর লাল নীল সবুজ টিকিট। তারা দুটাকার টিকিটটার অনায়াসে দাম চাইতে পারে বারো টাকা। সাত টাকার টিকিট হামেশাই বিক্রি হয় কুড়ি টাকায়।
তবু সকাল হতেই মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেজদারা টিকিট কাটতে দৌড়ায় ম্যাটিনি শোয়ের জন্য। এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পেলে তাদেরও সিনেমাটা আবার বিনা পয়সায় দেখা হয়ে যাবে।  সব থেকে ভালো সীটে বসে তারা সিনেমা দ্যাখে পিকলুদের সাথে, সাথে দেদার বাদাম বা তেলেভাজা। সব পিকলুর মায়েরই কেনা বা তৈরী করে আনা।  অতিথিপরায়ণতায় পিকলুদের পাড়ায় অনেক নাম। শুধুমাত্র পিকলুদের ভালোবেসেও ছোটুদারা সিনেমার লাইনে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। নিজেদের জন্য আলাদা টিকিট তারা কাটে না অনেকদিনই। 
তবে ব্ল্যাকে টিকিট কাটার পয়সা নেই পিকলুদের। অনেকগুলো টিকিট কাটতে হয় একসাথে। টিকিটের টাকা তো আর চাওয়া যায় না কারো কাছ থেকে। পিকলুর বাবা কোনোদিন তাদের ছবি দেখাতে নিয়ে যায়না। সুমিদি আর পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের নিয়ে মা নিজেই সিনেমা দেখতে যায়। 
পিকলুর অবশ্য টিকিট লাগে না। সে এর ওর কোলে বসে দিব্বি দেখে নেয় পুরো ছবিটা। সামনের মানুষগুলোর মাথায় পর্দা আড়াল হলে, সে দুটো সিটের ফাঁকে দাঁড়িয়ে পরে। দিদির সে ভাগ্য নেই। মায়ের কোল ছেড়ে ওঠা তার মানা।  অর্ধেক সিনেমা পিঙ্কিকে সামনের লোকের চুলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে হয়। সেই জন্য মা চেষ্টা করে কোনও টাক মাথার পেছনে বসার। তাতে সামনের পর্দার বাধা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। দিদি যেই সিন্ দেখতে পায় না, পিকলুকে পরে সেইগুলো বর্ণনা করে দিতে হয়। যেহেতু শেষের দৃশ্যে মারামারি ছাড়া আর কোনো কিছুতে তার আকর্ষণ নেই, পিকলু সে সব দৃশ্যগুলো নিজেও দেখেনি বা খেয়াল করেনি।  সে নিজের মত একটা গল্প গুঁজে দেয়। দিদি মেনে নেয়।  
পিকলুরা এখানে ভাড়াটে। এবাড়ির একতলাটা পুরোটাই ভাড়া দেবার জন্য বানানো।  পেছনে পুকুর রেখে ইংরাজীর ইউ ধাঁচের একটি দোতলা বাড়ি।  নিচের তলায় চারটে এক কামরার ঘর।  রান্নাঘর সবার আলাদা, বারান্দাও আছে সবকটি ঘরের সাথে, কিন্তু বাথরুম একটাই। যদিও পিকলুর জন্ম হওয়া অবধি তারা আর ঠাকুমারা ছাড়া আর কাউকেই একতলায় থাকতে দেখেনি সে।  এখানে কেউ ভাড়া নেয় না চট করে।  আবার কেউ নিতে চাইলেও ওপরের বড়মা তাদের নাকচ করে দেয়।  বাঁদিকের একদম প্রথম ঘরটা পিকলুদের। বাড়িটার মাঝখানে ইট বিছানো কাঁচা দালান। সামনেটা  একটা ছোট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।  পিকলু পাঁচিল লাফিয়ে এদিক থেকে ওদিক যায়।  অন্যদের পারাপারের জন্য একটা ছোট গেট লাগানো।  
চারটে ঘরের মধ্যে দুটো কিছুদিন আগেও পুরোপুরি বন্ধ ছিল।  ইদানিং ওপরের বড়মা একটা ঘরের তালা খুলে দিয়ে লোক ডাকিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে। সুমিদি ফাইভ থেকে সেভেনের ছাত্রছাত্রীদের টিউসন ক্লাস নেয় সেখানে। ঠাকুমা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শেখায় কয়েকজনকে।  বাকি সময়টা পুরো ঘরটা পিকলুর নিজের রাজত্ব। এ রাজ্যের রাজা বলে প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে নানান কাজে।  অনেক রাক্ষস-খোক্ষসও নিকেশ করতে হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রথম দিকে বড্ডো বেশি জ্বালাত তারা, প্রায়সই গরু বছর লোকেদের তুলে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে নিয়ে চলে যেত।  শেষে লোকেরা রাজামশাইয়ের পায়ে পড়লো। পিকলুকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কঠিন হাতে শাস্তি দিতে হল দুরাত্মাদের। 
এই তল্লাটে পিকলুদের বাড়ি ছাড়া পাকা বাড়ি আর প্রায় নেই।  পিকলুর বাবাই একমাত্র সকাল সকাল সেন্ট মেখে রুমাল পকেটে গুঁজে অফিসে যায়। বাকিরা বেশিরভাগই কাজ করে একটু দূরের  জুটমিলগুলোতে। প্রায় সবকটি বাড়ির মাথাই টালি দিয়ে ঢাকা। কিছু টিনের চালাও আছে।  আবার পাড়ার সীমানায় মাটির ঘরে খড়ের চালাও চোখে পড়ে অনেক।  সেগুলোতে জেলেরা থাকে।   
 ঠাকুমাদের ঘরটা পিকলুর সবচেয়ে পছন্দের।  জানলার একটু দূরেই পুকুর।  যেন হাত বাড়ালেই জল ছোঁয়া যাবে।  পিকলু খাটে বসে ঘুড়ি ধরার একটা লম্বা লগি জানালা দিয়ে বের করে নৌকা চালিয়েছে অনেক। আরো ছোটবেলায় দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, আমেরিকা অনেক দেশে সে ঘুরে এসেছে ঠাকুমাকে নিয়ে।  এখন একটু লজ্জা করে।  নৌকা চালাতে ইচ্ছে হলেও আর লজ্জা কাটিয়ে চালানো হয় না।  রাতে ঘুমাবার আগে তবে এই জানালার ধারে সে কিছক্ষনের জন্য বসবেই।  তখন মনে হয় বড় কোনো জাহাজে চেপে সে চলেছে অনেক দূরের কোনো দেশে। সেখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। রাতে শুতে না ইচ্ছে হলে শোবার প্রয়োজন নেই, বিকালে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত খেলতে নেই কোনো বাধা। পুকুরের ওপারে বড় রাস্তায় দূরের ল্যাম্পোস্টের ক্ষীণ আলো দেখে মনে হয় সমুদ্রের বুকে এক লাইটহাউস। লাইটহাউস নিয়ে প্রশ্ন করে সে সবাইকে বিব্রত করে দিয়েছিল কিছুদিন আগেও। বাবা  তারপর  একদিন লাইটহাউসের ওপর একটা ছবিওয়ালা মোটা বই এনে হাজির হল অফিসফেরতা। পুকুরের ওপারের আলোটা তার আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইটহাউস থেকে আসছে মনে হয় এখন।  বড় হলে সে প্রথমেই লাইটহাউস দেখতে বেরোবে।       
বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেমধ্যে তার জন্য ছোটদের বই নিয়ে আসে।  একটা দুর্দান্ত বই পড়ে এখন তার নতুন শখ গোয়েন্দা হবার। বইটার গোয়েন্দা ফেলুদার মতোই প্রায় যখন তার নামটা, তখন অর্ধেক কাজ তো এগিয়েই রইলো। ঠাকুমাকে বলা রয়েছে, ঘরে কিছু খুঁজে না পেলে যেন পিকলুদাকে তলব পাঠানো হয়।  
মাঝেমধ্যে বাবা ইন্দ্রজাল কমিক্স নিয়ে আসে তার জন্য। সেগুলোর ছবি দেখার জন্য বন্ধুরা মৌমাছির মত ভীড় করে।  বন্ধুরা তার থেকে বেশ বড় হলেও, ভালো পড়তে পারে না অনেকেই।  তাই পিকলুকে সবাইকে পড়ে শোনাতে হয়। ক্ষুদিরাম অবশ্য পড়াশোনায় ভালো, সে বই টেনে পড়ে নেয় নিজের মত।  পিকলুরা ইংরেজি স্কুলে পড়লেও, বাবা তাদের জন্য শুধুই বাংলা বই কিনে দেয়। 
ক্ষুদিরামরা বগলে চটের বস্তা নিয়ে ইস্কুল যায়। বেশিরভাগ দিনই স্কুলে না গিয়ে তারা সফেদার মাঠে খেলতে নামে। সেখানকার বেশিরভাগ ছেলেরা পাশেই মাদ্রাসার ছাত্র।  সকাল দশটার মধ্যে তাদের অনেকেরই ছুটি হয়ে যায়। সবাই দল ভাগ করে  খেললেও, সেগুলো দুপাড়ার মধ্যে ম্যাচ নয়।    
পাশে এক মগ জল নিয়ে পিকলু পুকুরপাড়ে দাঁত মাজতে বসলো। সামনে সবুজ জলে এক ঝাঁক তেলাপিয়া মাছ একই লয়ে খপ খপ করে মুখ বাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। ওরাও বোধয় এই সময় রোদ পোহাতে আসে। পিকলু হাত তুলতে ঝুপ করে তারা একসাথে ডুব দেয় গভীরে। আবার খানিকক্ষণ বাদে ভেসে ওঠে একসাথেই। ওপারে বাঁশঝাড়ে হলুদ একটা বাঁশ নুয়ে আছে জলের ওপর। সেখানে একটা নীল মাছরাঙ্গা। রোজ আসে। আরো খানিক পরে কালো পানকৌরিগুলো আসবে,  একটা খঞ্জনা লেজ নাচিয়ে ঘুরে বেরাচ্চ্ছে।  কলমি গাছের জঙ্গলে একটা তিতির পাখি তার বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেরাচ্চ্ছে।  কিন্তু পিকলুর আজ ওসব দেখতে ভালো লাগছে না।  
খালপাড়ে গিয়ে বাসটাকে যদি একবার দেখা যেতে পারতো।
দিদির কান্নার গলা শোনা যাচ্ছে। নিশ্চই বাবা ফিরে এসেছে বাজার থেকে। দিদি এখন এমন একটা ভান করবে যেন রাতে ঘুমিয়ে থাকাটা খুব কষ্টকর একটা ব্যাপার। বাবাকে এখন আদর করতে হবে অনেকক্ষণ ধরে। পিকলুর এসব বাচ্চাদের মতো আচরণ ভালো লাগেনা। ছুটির দিনে পারলে ও রাতেও ঘুমায় না। যত সকাল-সকাল খেলতে বেরোনো যায়, তত ভালো। অন্য দিন হলে আর কিছুক্ষণ পরেই ক্ষুদিরাম, ফড়িং, লালুয়া, বিন্টু , উদয়, সুব্রত, মানা, তারক, অঙ্কুর, সোনাই সবাই চলে আসতো ব্যাট-বল নিয়ে। খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে, মাথায় ক্যাপ পরেই তারও বেরিয়ে পড়ার কথা।   দুপুরে মা তিনবার পর্যন্ত ঘরে ঢুকতে না বললে ফেরত আসার প্রশ্নই ওঠে না। মাঝে মধ্যে বাবাও তাদের সাথে খেলতে চলে আসে। বাবাকে দেখলে পল্টনকাকুও বল হাতে তুলে নেয়।  তারপর একে একে অনেকে এসে হাজির হয় মাঠে। ওঃ, রবিবারটা এক্কেবারে জমে যায়।    
পিকলুর কাছে একটা সত্যিকারের ব্যাট আছে।  টিভিতে কপিল দেব, গাভাস্কারের হাতে যেমন, ঠিক সেরকম। সে সবার থেকে ছোট হলেও, ব্যাটটার জন্য তার আলাদা মর্যাদা সবার কাছে। এমনিতে তাদের খেলার ব্যাটটা নারকেল কাঠের, খালের ওপারে কাঠ চেরাইয়ের কলে তৈরী করে আনা। প্রথম প্রথম হাতে চোঁচ ঢুকে যায়, কিন্তু খেলতে খেলতে ব্যাটটা চকচকে মসৃণ হয়ে যায়। তারপর সেটা বৃষ্টিতে না ভেজা অবধি তোফা চলে। পিকলু অবশ্য তার ব্যাটটা দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি। তবু, বন্ধুদের তোয়াজ তার ভালো লাগে।
আগের কথা

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...

হাবিজাবি ১

আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ।  সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে।  বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া।  বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্ম...