বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা।
কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না।
লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা যাক। ভাদুড়ী মশাই তার ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, বাংলা কথাটি প্রাথমিকভাবে এসেছে তুর্কি শাসকদের দলিল থেকে। আগে বঙ্গ বলতে বোঝানো হতো অধুনা বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের ছোট একটি জায়গা। তাছাড়া বরেন্দ্র, সমতট, রাঢ়ি এরকম আরও কিছু অঞ্চল ছিল। তিনি বললেন, তুর্কি রাজারা সমস্ত অঞ্চল এক করে নাম দিলেন গৌড়বঙ্গ। সেখান থেকে বাংলাহ, মানুষদের বললেন বঙ্গালীহ। কথাটি আমার ঠিক মনে হলো না।
বাংলার ইতিহাস নিঃসন্দেহে আরও অনেক পুরনো। তুর্কিদের আগমনের আগে থেকেই বাংলাভাষী জনগণ নিজেদের বাঙালি বলে এসেছে। পাল বংশের রাজারা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের রাজত্ব উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। অতটা না হলেও, বাংলা ভাষার চলন ভারতবর্ষের অনেক দূরদূরান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তুর্কিরা তার পরে এসেছিলেন।
সুকুমার সেনের বাংলা ভাষার ইতিহাস ঘেঁটে উত্তরটা খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগলো না। চর্যাপদের ভূসুকূপাদের কাব্যে বঙ্গাল ও বঙ্গালী কথার উল্লেখ একই পদে এক সাথে পাওয়া যায়। আমি সেটাই ভাদুড়ী মশাইয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বললাম।
এটি বলার মধ্যে নিজেকে জাহির করার ইচ্ছে ছিল না। যাতে ভাদুড়ী মশাইয়ের অপমান না হয়, সে ব্যাপারে কুণ্ঠা ভাবে বলব কি বলবো না ভাবছিলাম। তাছাড়া আমার ভুল হবার সম্ভাবনাও অনেক।
আমি তাই ছাত্র হিসেবেই মাস্টারমশাইয়ের সামনে উপস্থিত হলাম। ভেতরে গভীর তাগিদ অনুভব করছিলাম।নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতো মানুষ একটি প্রতিষ্ঠান। তার অবদান বাংলা ভাষায় সুবিশাল। তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে গণ্য হবেন, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তার গুণমুগ্ধ পাঠকের মধ্যে আমিও একজন। তার ইউটিউব চ্যানেলের দর্শকও প্রচুর। ভাদুড়ী মশাই যেটা বলবেন, তার বিরোধিতা কেউ করবে না। ক্রমে ক্রমে সেটিই প্রামাণ্য ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে।অথচ আসল ইতিহাস তা নয়।
আমাদের বাংলার ইতিহাস বিদেশীদের হাত ধরে আসেনি। চর্যাপদ দশম শতক বা তারও আগে লেখা হয়েছিল। অর্থাৎ, তুর্কিদের বিজয়ের অন্তত তিনশো বছর আগে। অনুমান করা যায়, বাংলার অস্তিত্ব তারও বহু শত বছর আগে থেকেই ছিল। অর্থাৎ, তুর্কিদের আগমনের বহু আগে থেকেই বাংলা এবং বাঙালি নামটির চলন ছিল। তাই সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা জরুরি।পণ্ডিতমশাইয়ের ভিডিওটির টাইটেল ছিল বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংকট। ইতিহাস একটু ভুল হলে, সংকট বাড়বে, বই কমবে না। মানুষ চর্যাপদ পড়বেন না, কিন্তু ভাদুড়ী মশাইয়ের আধা ঘণ্টার ভিডিও দেখে ইতিহাস গড়ে নেবেন। সেটাই প্রশ্ন তোলার তাগিদ বাঙালি হিসাবে বোধ করলাম।
রাত দশটা নাগাদ জিজ্ঞেস করেই নিলাম। উনি রাত একটা নাগাদ উত্তর দিলেন:
“আপনি একেবারে সঠিক কথা বলেছেন।”
ভুসুকূপ পদটি নিচে তুলে দিলাম। সুকুমার সেনের বই থেকে নেওয়া:
“আদয় বঙ্গালে ক্লেশ লুড়িউ।
আজি ভুসুকু বঙ্গালী হইলী।
নিঅ ঘরিণী চন্ডালে লেলী।”¯
মন্তব্যসমূহ