সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হাবিজাবি ১


আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ। 

সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে। 

বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া। 

বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্মুখী হচ্ছি, বুঝতে পারছি সেটাই বোধয় সবার সেরা শখ। নিজের সাথে নিজে কথা বলা। চাইনা অন্য কেউ সেসব পরুক। একটা  ডায়েরি লেখা গেলে ব্যাপারটা মন্দ না। 

জর্জ অরওয়েল এর আলদউস হুক্সলের তথ্য, ইনফরমেসান, এর ওপর দুটো কথা খুব ভালো লাগল। দুজনেরি নিষ্কর্ষ এক। ভবিষ্যতে মানুষের কোনও বক্তব্যই থাকবে না তথ্য নিয়ে। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে সে ব্যপারে দুই মনিষীর দুই ধরনের বক্তব্য। অরওয়েলের মতে, মানুষের কাছ থেকে তথ্যের অধিকার কেড়ে নেওায়া হবে। ওদিকে হুক্সলেয়র বক্তব্য ঠিক উলটো। উনি বলেছেন মানুষকে এমন তথ্য সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হবে যে কোনটা প্রয়োজনীয় এবং কোনটা বিনোদন, মানুষ তার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আজকের পৃথিবী আর অরওয়েলিয়ান নয়, আজকের পৃথিবী হুক্সলেয়র পৃথিবী। চতুর্দিকে কত তথ্য, গ্যানের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সেটা যেমন গ্যানপিপাশু মানুষের জন্য স্বর্গ্য, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমনই ভয়ঙ্কর। গ্যান হোল প্রদিপের জিনির মত, তাকে ঠিক মত কায়দা করতে না জানলে তা ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ। বাইবেলে যেমন ঈশ্বর পইপই করে মানা করেছিলেন, ওরে আপেল খাস নে খবরদার। মানুষ বুঝি আবার নিষিদ্ধ আপেলে কামড় দিয়েছে। 

লোকে এখন আসল নকলে কিছু ভেদাভেদ করতে পারছে না। বুদ্ধিমান থেকে ভোঁতা, সবাই এখন নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে আটকে গেছে। সে কি ভীষণ নেশা। সমাজের সব গণ্ডি পেরিয়ে, দেশ কাল সীমানার ব্যাবধান ছাড়িয়ে তারা বকে যাচ্ছে অনর্গল। তারা নিজেদের পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু অনুমান করে ইন্টারনেট ভরিয়ে দিচ্ছে অসভ্য ভিডিওতে। লজ্জা, শরম গেছে বহুকাল, মোবাইল ফোনের স্ক্রীন থেকে সারা পৃথিবীটাকে তারা ভরিয়ে দিচ্ছে হিংসায়। অপমানের চূড়ান্ত, হেনস্থার শেষ নেই সেখানে। অসহায় মানুষকে তারা তাড়া করে বাধ্য করছে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। সমাজের বিকৃত হোতা হয়ে তারা ঠিক করে দিচ্ছে পঙ্গু মূল্যবোধ।  ভুল করে আবার নিজেদের মধ্যে সামনাসামনি দেখা হলে সেই মানুষগুলি বুঝতে পারছে না কথা শুরু করবে কি ভাবে। এ বড় অদ্ভুত এক দুনিয়া। 

জানিনা আমার মেয়ের প্রজন্ম কেমন হবে, হয়ত তারা এসবের ধাঁধা বুঝতে পেরে যাবে অনেক আগেই। কিন্তু সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও ভয়ঙ্কর এক বস্তু -- 
কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তা, বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। 

কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তার দৌলতে মানুষের চাকরিবাকরি থাকবে কিনা, এবং সংসার কিভবে চলবে, সমাজ কিভাবে পরিবর্তিত হবে, সেটা আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। গতকাল একজন বিদগ্ধা ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে বুঝলাম সিঙ্গাপুরের মত দেশে কৃত্রিম  বুদ্ধিমতায় রাশ টানার প্রচেষ্টা চলছে। তাদেরকে কাজের দুনিয়ায় চট করে আনা যাবে না, লোকের কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষের থেকে অনেক বেশি এবং অনেক সহজে সেসব বুদ্ধিমত্তা কাজ করবে। কিন্তু মানুষকে টিকিয়ে রাখার জন্য, খেলা চালু রাখার জন্য, সেসব ঠেকিয়ে রাখা হবে যতদিন পারা যায় ততদিন।

নিশ্চিত, কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এখনও আমরা কিছুই দেখিনি। শুধু এইটুকু মনে ওয়, এসবকে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। আসলে মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই জগতের যখন যেমন দরকার, তখন তেমনভাবে সব কিছু তৈরি হয়ে যায়। যখন ডাইনোসরের প্রয়জনিয়তা ফুরিয়ে ছিল, তারা বিলুপ্ত হয়ে স্তন্যপায়ী এলো। আবার তাদের মধ্যে থেকে মানুষ উঠে বিলুপ্ত করল বেশিরভাগ মাম্মালসদের। যারা বেঁচে  আছে, তারা নিতান্ত মানুষের কৃপাতেই টিকে,  আজকেই ইচ্ছে করলে সব খতম করে দিতে পারে আমাদের প্রজাতি এমনই শক্তিশালী এবং নির্মম। পুরো পৃথিবীটা এখন একটা বিশাল চিড়িয়াখানা। সেই চিড়িয়াখানার শেষ স্তন্যপায়ী হবে একদিন মানুষ নিজে। ব্যাপারটা আসলে কোনদিন মানুষকে নিয়ে ছিল না। মানুষ নিমিত্ত মাত্র, একটি বিশেষ প্রয়োজনীয়তার জন্য সযত্নে বড় করা মুসলমানের মুরগি। এই পৃথিবী একটি জীবিত সত্তা, যে কিনা আবার ত্রিকালদর্শী। ফ্যিসিক্সের সব নিয়ম ছাড়িয়ে তার নিজের কিছু নিয়ম আছে, আমরা সে হদিস পেয়েও পাইনি। সে নিয়ম যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারব, তত বেশি হয়ত পারব টিকে থাকতে। 

এই পৃথিবীর বেঁচে থাকার তাগিদেই বুঝি কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তা উঠে আসছে। একদিন এদের হাতেই ধ্বংস সুনিশ্চিত মানব সভ্যতার, বা বেঁচে থাকলেও সেটা তাদেরই দয়াতে।  একদিন মানুষ আর কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় হয়ে তৈরি হবে নতুন এক বুদ্ধিমত্তা, এক নতুন সত্তা। সেই নতুন প্রাণী হবে সব দিক থেকে পারফেক্ট। সে প্রাণী বয়ে বেড়াবে মানুষের আবেগ, আর শত সহস্র কম্পিউটারের বুদ্ধি। সেটা যে হবেই তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সিনেমাতে সেসব আকছারই হচ্ছে, মানুষের ভবিষ্যৎ সবাই না বুঝলেও কিছু সংবেদনশীল প্রাণ অঙ্কে আগেই বুঝে গেছে এবং বিনোদনের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়ে চলেছে ক্রমাগত। এটা একরকম কনডিশানিং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়ার। যখন এটাই চরম বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে, তখন যেন স্বীকার করতে কষ্ট না হয়। আমরা তা ঠেকাতে পারব না। কিন্তু যত দেরি করা যায় আরকি।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...