আজকে বিজয়া দশমী। আর কিছুক্ষন বাদেই আমাদের ঠাকুর বিসর্জন হবে। অথচ আমার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। এ বড় অদ্ভুত এক পুজো দেখলাম। করোনা পরবর্তী জগৎ কেমন হবে জানা নেই, তবে অনেক কিছুই উল্টে পাল্টে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। 'কেবল' টিভি আসার পর যেমন জীবন বদলে গেলো সবার। এখনকার নিরিখে কি সামান্য এক ব্যাপার, অথচ আমাদের মধ্যে উত্তেজনা প্রবল। ইস্কুলের ক্লাসে বসে আমরা একে অপরকে টেক্কা দিয়ে গুল মারতাম। কোন্নগর এ কেবল আসেনি, কিন্তু গয়া তে আমার মামার বাড়িতে কেবল টিভি। সেখানে নাকি মাঝে মধ্যেই মাইকেল জ্যাকসনের নাচ দেখা যায়। আমিও নাকি মামার বাড়ি গেলেই সারাদিন খালি জ্যাকসনের নাচ দেখি।
এবার পুজোটা অনেকটাই ম্রিয়মান। লোকের কাছে টাকা নেই, রোগাক্রান্ত হবার ভয়। অথচ কোথায় যেন বাঙালি বেশ অকুতোভয়। সেটা পরিণতি অনুধাবন করার ক্ষমতা নেই বলে, নাকি বাঙালি অদৃষ্টবাদী সেটা বিশেষ বোঝা যায় না। এমন হতে পারে, এখানে বোধয় করোনা সত্যি তেমন একটা কিছু করতে পারে নি, অথবা হয়তো করোনাটা এখন খুব বেশি মারক নয়।
আজকে আমি অফিসের হয়ে কাজ করছি, একটা রুপি আউটলুক স্টোরি করবো। বৌকে শশুর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসলাম, সেখানে তার ছোটবেলার বান্ধবীদের সাথে সিঁদুর খেলা করবে। এখানে এসে বৌয়েরও ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। মুম্বাই থাকাকালীন বাড়ি থেকে বেরোয়নি ছয় মাস। বেশ ভয় পেয়েছিল বোঝা যায়।
বাংলার অবস্থা বাইরে বসে করুন মনে হতে পারে, কিন্তু এখানকার লোকজন মানিয়ে নিয়েছে। বিশেষ কোনো অভিযোগ নেই, বাঙালি এমনিতেই অল্পতেই খুশি। চাপা অভিযোগ নিশ্চই আছে, কিন্তু সেটা জানিয়ে লাভ নেই বলে বাঙালি আর অভিযোগ করে না। আশেপাশের থেকে যে সব কোলাহল শোনা যায়, সে সব কিছুই ক্ষুদ্র স্বার্থের কিছু রাজনীনিতিবিদদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শকুনের কান্নার মতো। সেই প্রতিবাদে প্রাণ নেই, নেই প্রাণ বিসর্জন দেবার বেপরোয়া তাগিদ। সেটা এক ধরনের ভাড়া খাটা। তাতে সাধারণ মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু তাপ তারতম্য হলেও, আদপে কোনো লাভ নেই। তাই, মানুষ আর বিপ্লবের প্রতি আকৃষ্টও হন না। বামফ্রন্ট সরকার 'বিপ্লব' কথাটিকেই খেলো করে দিয়ে গেছে। ছোটবেলায় আমাদের জ্যাঠা, বাবা, কাকারা যে কত বিপ্লব করেছে ব্রিগেডে গিয়ে, তার হিসেব নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে তৃণমূল যোগ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলায় এখন আমাদের বয়সী ছেলেরা একের পর এক বিজেপি যোগ দিচ্ছে। কালকে যদি বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় ফিরে আসে, অমনি দক্ষিনপন্থীরা দল বদল করে রাতারাতি দারুন প্রগতিশীল চড়া সাম্যবাদী হয়ে যাবে। এটা বোধয় একধরনের অসহায়তা, বাংলায় পলিটিক্স না করলে অনেকেরই হাড়িতে ভাত চড়বে না। সেটা আজ থেকে নয়, আমার জন্ম থেকে দেখা এক ব্যাপার। বাঙালি বুদ্ধিমান বলে একটু অলসও বটে। রাজনীতিতে খুব কম পরিশ্রম করে দ্রুত উপরে উঠে যাওয়া যায়।
এবারের ঠাকুরগুলো ছোট হয়েছে, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় নেই। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে একটা পরিধির বাইরে থেকে ঠাকুর দেখতে হচ্ছে মানুষকে। রাস্তায় ঠেলাঠেলি নেই। মফস্বল থেকে এবার কলকাতায় পুজো দেখার ঢল নামেনি। এক দিক থেকে দেখতে গেলে, এটাই ভালো। কিন্তু তাতে দুর্গাপূজাটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে। বাঙালির শান্ত ক্লান্ত জীবনে দুর্গাপূজোটা একঝাঁক তাজা বাতাসের মতো। পুজোর দিকে তাকিয়ে থেকে বাঙালি দিন কাটায় জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে। এবারের পুজোয় রাজ্যসরকার থেকে সব প্যান্ডালগুলোকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। সন্দেহ হয়, সেগুলো বোধয় আমফন ঝড়ের পর আমাদেরই তুলে দেয়া টাকা। বাংলার মানুষ বুঝবে না, কিন্তু যারা বাংলার বাইরে বসে এই টাকা ত্রাণ তহবিলে পাঠিয়েছে, তাদের প্রতারিত হবার কথা মনে হতেই পারে।
চাকরি জীবনের প্রথম দিকটায় বাংলায় ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলাম বার কয়েক, আমার তৎকালীন বাঙালি বস, যিনি তখনি নিজগুনে স্বনামধন্য, আমাকে নানা অছিলায় আটকে দিয়েছেন। পরে দেখেছি, তিনি আমাকে পুত্রসম স্নেহ করেছেন, আমার বিয়েতে নিজে কলকাতায় এসেছেন এক-দুদিনের জন্য, রিষড়ায় একটা বেশ বাজে লজে রাত কাটিয়েছেন। দাঁড়িয়ে থেকে আমার বিয়ে দেখেছেন। বুঝি, তার অভিজ্ঞতা এবং স্নেহ দিয়ে তিনি আমায় ঢেকে রাখতে চেয়েছেন। তবু, বাংলায় কোথায় যেন একটা কি আছে। তাতে মানুষ বারে বারে বাংলার মাটিতে ফিরে আসতে চায়। যেমন আমরা যারা ইকোনমিক রেফিউজি তারা, হয়তো বোম্বাই বা দিল্লিতে বাড়ি কিনেছি, কিন্তু কলকাতাকেই নিজের শহর মনে হয়। জাদুর বাংলা, এল-ডোরাডোর মতো সোনার বাংলা। আমরা সোনার লোভে প্রতিবছর ফিরে আসি বাংলার বুকে। প্রানভরে শ্বাস নিয়ে বলি, "আঃ!"
বাংলার হাওয়ায় বোধয় সেই সোনা মিশে আছে। মনে হয়, এখানে থাকতে পারলে কি ভালোই না হতো।
বাংলা ছেড়ে যাবার সময় চলে এলো প্রায়, আবার একটু একটু মন ভারি হচ্ছে। কিন্তু বেশিদিন থাকতে ভালো লাগে না, কোথায় একটা যেন ভয় ভয় করে। 'লোটাস ইটার' গল্পটার কথা মনে পরে। তারপর খুব গভীর খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করি, কেন এমন অনুভূতি। বেশি গভীরে যেতে হয় না, উত্তরটা অনেক আগেই সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমি যে কারনে প্রথম বাংলা ছাড়ি, সেটি এখনো বৈধ।
বাংলা আমাদের প্রজন্মকে বড় করলেও, আমাদেরকে উপার্জন দেবার কোনো প্রবন্ধন করতে পারে নি। আমরা বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ছেলেরা চপশিল্প বা টোটো চালনা দুটোর কোনোটাই করতে পারবো না। যারা বেরিয়ে যেতে পেরেছে, তাদের অনেকেই ভাবে তারা বেঁচে গেছে। কেউ কেউ আবার হয়তো ভাবে তারা বোধয় ইংরেজিতে যাকে বলে 'লেট ব্লুমার', এবং ইস্কুলে তাদের আগের কুড়িটা ছেলে বোধয় ছোটবেলায় ভালো, বড়বেলার হরবোলা। এরকম তো হয়েই থাকে। সেই উষ্মা অনেক প্রবাসী বাঙালির মধ্যেই আমি লক্ষ্য করেছি। এদের যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি।
আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যারা একেবারে ছাপোষা, রিস্কফ্রী বাঙালি। আমরা চাকরির গন্ধে গন্ধে, নেহাত বেঁচে থাকার তাগিদেই হয়তো, অথবা স্বপ্নপূরণের তাগাদায় বাংলা ছেড়েছি বহু বছর। হয়তো বুকের একটা দিক অকেজো হয়ে গেছে, কিন্তু প্রানধারন করতে পেরেছি, জানি পরের প্রজন্মকে তৈরী করে জীবনের বহ্নিশিখা আরেকটু এগিয়ে দিতে পারবো। যারা থেকে গেছে, তারা প্রায় সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে, অথবা গভীর অবসাদ বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। তাদের কেউ প্রতিভার দাম পেল না। সেই যুবসমাজের প্রতি চরম তঞ্চকতা করা হয়েছে। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পেল না। সবারির কথা বলছি না, কিন্তু আমাদের মতো মধ্যমেধার মানুষদের প্রতি এই বিস্বাসঘাতকতা পিঠে ছুরি মারার মতই একটি ব্যাপার। এর জন্য কে দায়ী -- কেন্দ্রীয় সরকার, না রাজ্য সরকার -- সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। তবে রাজনৈতিক অপদার্থতা এবং সেই অপদার্থদের মাথায় তুলে নাচার প্রবণতা বাঙালির সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
গতকাল প্রিয় বাল্যবন্ধুদের সাথে একটা ছোট পানীয়ের আসর বসেছিল। আমরা কেউ নেশাখোর নই , একটু গলা ভিজিয়ে পুরোনো দিনের কথা রোমন্থন করা, এই আর কি। শুনলাম আমাদের সাধের নবগ্রাম বিদ্যাপীঠে নাকি আর কেউ নিজেদের বাচ্চাদের পাঠায় না। এখন নাকি বাংলা মাধ্যমে আর বাচ্চাদের পড়তে পাঠানো হয় না, সাধ্য থাকলে সবথেকে ওঁচা ইংরেজি মাধ্যমেই বাচ্চাদের দেয় সবাই। মনে পড়লো বিদ্যাপীঠে আমায় সাত ক্লাসে ভর্তির সুযোগ করে দেয়ার প্রচেষ্টায় আমার বাবার কি করুন অবস্থা হয়েছিল। শুনে একটু মন খারাপ হয়ে গেলো। তাহলে কি বাংলাটা সত্যি একদিন পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আমরাই শেষ প্রজন্ম যারা বাংলা ভাষাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি?
তখন আবার ফেরত চলে যেতে ইচ্ছে করে। মুম্বাইতে আমার নিজের জগৎ, বাংলায় ফিরব পর্যটকের মতো হয়ে প্রায়, এদেশ নিয়ে আমার বিশেষ কোনো বক্তব্য দেবার কোনো অধিকার নেই, আমি এদেশে তেমন কিছু দিতে পারি নি। অথচ বাংলার বাইরেটাও আমরা নিজেদের বলে মেনে নিতে পারিনি। আমরা চিরটাকাল শিকড়হীন হয়েই থেকে যাবো। জানিনা কেন, কিন্তু আমাদের মাথার ওপর বোধয় ঝুলছে গভীর কোনো এক অভিসম্পাত, মাকে দুঃখের দিনে ছে ড়ে দিয়ে চলে গেছি বলে। কে জানে, এই জন্মে সেই অভিশাপ কাটবে কি না।
মন্তব্যসমূহ