সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গোধূলির মুহূর্তগুলো

আমার সাংবাদিকতার আর কটা দিন মাত্র বাকি। সমস্ত জায়গা থেকে সাংবাদিকদের চাকরি যাচ্ছে, খবরের কাগজের অবস্থা খুব শোচনীয়। এরকমটি ভাবি নি। ভেবেছিলাম, সাংবাদিকতা করেই জীবন কেটে যাবে। মাঝখানে এসে যে রাস্তা বদল করতে হবে, তা জানলে হয়তো .... অবশ্য কি বা আর করতাম, লেখা লেখি ছাড়া তো আর কিছুই জানি না। জানতে ইচ্ছেও জাগে নি কোনোদিন, জানার তাই চেষ্টাও করিনি। এখন যখন সংসারপাতি পেতে বসেছি, এই দিশাবদল অনেকটাই দিশেহারা করে দিচ্ছে।

মাঝে মধ্যে এখন পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। আমি চাকরি করতে চলে যাচ্ছি সুদূর শিলংয়ে, পীঠে একটা ক্যানভাসের বেডিং, মোটা চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাঁধা। পেছনে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মা আর বোন। ছলছল চোখ তাদের। মা ভীষণ কেঁদেছে তার আগে, আমিও একটু কেঁদেছি। সেটা মাকে ছাড়ার দুঃখে, নাকি মাকে দেখিয়ে অভিনয়, নাকি নতুন জীবনের অনিশ্চয়তার ভয়ে, সেটা আজ আর ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমি পিছন ফিরে তাদের দিকে তাকাই নি। সাইকেল রিকশা আমায় নিয়ে মন্থর গতিতে গড়িয়ে চললো বড় শিবমন্দির পার করে কোননগর স্টেশনের দিকে। আমি ভেসে পড়লাম। 

অনেক পরে এটা নিয়ে একটু অতিরঞ্জিত একটা কিছু লিখেছিলাম আমার ব্লগে। The boat has lifted its anchor না এরকম দার্শনিক কিছু। সবটাই অতিকথন। জীবনটাকে কোনোদিনই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবিনি। সবটাই আমার খেলা করা। বিয়েটাও খেলা করে করলাম, বাচ্চাটাও খেলার ছলে জন্মালো, বাড়িটাও খেলতে খেলতে কিনে ফেললাম, কুড়ি বছর ধরে ইএমআই দিতে পারবো কি পারবো না, অতশত না ভেবে। 

কিন্তু এখন বাচ্চাটার মুখ দেখে আর ছেলেখেলা করতে ইচ্ছে করে না। এখন একটু সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করি, টাকাপয়সা রাখার চেষ্টা করছি যাতে মেয়েটাকে আর কিছু না হোক, ভালো পড়াশোনা করাতে পারি। বাঙালি মধ্যবিত্ত তো আর নিজের পরের প্রজন্মের জন্য রাজার ঐশ্বর্য ছেড়ে যায় না। শিক্ষাদীক্ষাটা ঠিকঠাক করাতে পারলেই যথেষ্ট। সেটাই করাতে হবে আমাদের। আমার স্ত্রী আর আমি যে প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছি, তার প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের পালন করতেই হবে। ঠিক যখন এমন সব বড় বড় কথা ভাবতে আরম্ভ করেছি, (মানে ভাবতে বাধ্য আমার স্ত্রীর দৌলতে, উনি আবার খুব গম্ভীর একটি চরিত্র, যিনি অল্পতে বেশ বিচলিত হয়ে যান), ঠিক তখনই চাকরিটা যাবার প্রস্তুতি হচ্ছে।

কেন এমন হলো জানিনা, তবে এমনটা হওয়ার ছিল। লোকে এখন আর কাগজ পরে না। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, খবরের কাটতি বেশ ভালোই, আগের থেকে অনেক বেশি। তবে সেসবই বিনা পয়সার পড়া, নিজের ফোনের স্ক্রিনে। কোনো এডভেরটিসমেন্ট নেই। তারপর সরকারও চায় না দিন রাত এই শার্দুলশাবকদের সহ্য করতে। কাজকম্ম তো কিছু করিনা আমরা, শুধু রাত জেগে ঘেউ ঘেউ করা। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই চিৎকার করে পাড়া মাথায় করা। পাগল কুকুরদের মেরে ফেলাই তো নিয়ম। এর থেকে গরু ভালো। তবে কিছু পোষা কুকুরও থাকে যারা লেজ নাড়তে পারলে আর কিছু চায় না। তাদের যত্ন করে রাখলেই আর পশুপ্রেমীদের কোনো অভিযোগের কারণ নেই। রাত জাগা প্রাণীদের হাতে মারার দরকার নেই, ভাতে মারলেই হবে।

যাই হোক, আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার সাংবাদিকতার স্বপ্নচারণ শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। তাই এই সাঁঝবেলায় পড়ন্ত সূর্যের আলোতে প্রানপন নিজের গা ভিজিয়ে নিচ্ছি। 

তবে চাকরি চলে গেলেই যে পথে বসবো তা মনে হয় না। আমার সঞ্চয় কিছু নেই বটে, তবে বাজারে একটা সুনাম আছে মাথার কাজ করতে পারি বলে। আশা করা যায় কোথাও না কোথাও কিছু একটা করে টিকে থাকতে পারবো। বোধয় সাংবাদিকতা করে যা রোজগার করি, তার থেকে ভালোই কিছু কামাবো। 

শ্রেয়া, তুমি কোনোদিন এই লেখাটা হয়তো পড়বে।  হয়তো তখন আমি আর সাংবাদিক নই , কিন্তু তুমি জানবে তোমার বাবা মাকে যে প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম তোমায় ভালো রাখার, সেই প্রতিশ্রুতি আমি কোনোদিন ভঙ্গ করি নি।  তবে তুমি যাকে বিয়ে করেছিলে, সে ছিল এক নির্ভীক, সৎ সাংবাদিক।  তুমি সেই গৌরব হারাবে, আর আমিও হয়তো আর কোনোদিন আয়নার সামনে দাঁড়াবো না।  

x

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...

হাবিজাবি ১

আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ।  সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে।  বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া।  বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্ম...