সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

"যা জান, তাই লেখ।"

 "যা জান, তাই লেখ।" 


এই কথাটি যে কত মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তার হিসেব নেই। লেখালেখিটা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। এটা অনেক সময়েই তাগিদ। যারা পেশাগত লেখক তাদের কথা বলছি না। শিবরাম বাবু একবার বলেছিলেন, কলম ঠেলা আর রিক্সা ঠেলার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই।

আমি বলছি আমার মত সৌখিন মানুষদের কথা যারা লেখালেখি করি নিজের মনের খাদ্য জোগাড় করার জন্য। এটা আমাদের একটা বিলাসিতাও বলা যায়। গাড়ি নিয়ে যেমন হাওয়া খেতে বেরনো হয়, তেমনি কিছু একটা। কিন্তু তার জন্য অনেক মেহনত করে একটা গাড়ি কিনতে হয় আগে।

এই যে চাকরিটা করি, সেটা দিনের শেষে বাংলা লিখতে পারার অধিকারের জন্য। এটাই সার কথা।

সখের লেখা লিখি বলে আমার কোনও দায়বদ্ধতা নেই কল্পনাকে বেশি কষ্ট দেয়ার। তাতে দুটো সুবিধে হয়। বেশি বুদ্ধি খাটাতে হয় না, আবার বেশ গড় গড় করে লিখে যাওয়া যায়। লেখাটা হয়ে গেলেই বন্ধুদের ওয়াটসআপ গ্রুপে সেটা স্প্যাম কর এক ক্লিকে। এক-দুজনের ভাল লাগতে পারে, তারা বাহবা করে। যাদের ভাল লাগে না, তারা চুপ থাকে। খারাপ কথা শুনব ভেবে তো লেখা কেউ পাঠায় না বন্ধুদের। বন্ধুদের কাজই হল সব ব্যাপারে হাততালি দেয়া। যা কিছু গালি দেয়ার, সেটা ব্যাক্তিগত ভাবে দেখা করে দিতে হয়। ওয়াটসআপ গ্রুপের দয়ায় আমরা আজ ছোট ছোট দলের মধ্যে বেশ বিখ্যাত লেখক। সে আমাদের লেখা কোথাও ছাপা হোক বা না হোক।

বাঙ্গালিরা, বিশেষত, সবাই লেখক।

আর সেই জন্যই আজকাল আর পূজা সংখ্যাগুলো ছোঁওয়া যায় না। সেগুলো তো আর বন্ধুদের লেখা নয়, গল্প শেষ করে ধরে মারতে ইচ্ছে করে।

এতদিনে বুঝেছি এটা কেন হয়। বাঙ্গালি যা জানে তাই লেখে। যেহেতু বেশিরভাগ বাঙ্গালির জীবন -- বাজার, দোকান, বাচ্চা-কাচ্চা, ব্যর্থ প্রেম, জেলুসিল-প্যান ডি, পৃথিবীর কদর্যতম ব্যাকরণহীন যৌনতা (নিজের কল্পনায় পরে সেটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়) -- সেহেতু এক বাঙ্গালির লেখার সাথে অন্য বাঙ্গালির লেখার পার্থক্য খুব বেশি না। বাঙ্গালি জানে কম, লেখে অনেক বেশি। তাই সব লেখাই এক। হ্যাঁ, শব্দশিল্পী (কথাশিল্পী নয়) অনেকেই আছেন। তাই কারও লেখনী পড়তে ভাল লাগে, কাররটা নুন ছাড়া ইলিশ মাছের ঝোল মনে হয়। কিন্তু বিষয়বস্তু সবারির এক, কারোর লেখায় কোনও তারতম্য নেই।

অবশ্যই বাঙ্গালির মধ্যে কিছু আছেন সত্যিকারের লেখক। কিন্তু সবাই যেহেতু আজকাল নিজেদের লেখক ভাবেন, এই সব সত্যিকারের লেখকদের চেনা মুশকিল। সব জাতিতেই কিছু জন্ম লেখক থাকে। তারা না লিখে থাকতে পারবে না বলেই লেখে। বিষয় হল, সেখানে বাকি সব কাঁড়িগুষ্টি লেখার কাজ করে না বলে অন্য জাতির লেখকদের চট করে চেনা যায়।   

যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ভিড়ের মধ্যেও স্বতন্ত্র, তার লেখাতেও, বিষয়বস্তুতেও। চরিত্রগুলি জানা মনে হলেও, পরিস্থিতি চেনা লাগলেও, সেগুলো যেন ছুঁয়েও ছোঁয়া যায় না কেমন। তিনি একেবারে নিজের জীবনের জানা কথাই শুধু লিখেছেন। কিন্তু সুনীলের জীবন এই বাংলার বুকে সব বাঙ্গালির থেকে একেবারে আলাদা। তার জানা বিষয় সব বাঙ্গালির জানা কেন হবে? তাই তাকে যারা নকল করে তার মত লেখার চেষ্টা করে তাদেরকে হাস্যকর ভেকধারী মনে হয়।

আবার ওদিকে আছেন সত্যজিৎ রায়ের মত মানুষ। তার বাবা সুকুমার রায়ের দিকে আর গেলাম না, আমার মতে বাবা ছেলের থেকেও অনেক বেশি প্রতিভাশালী ছিলেন (আমার একান্ত ব্যাক্তিগত অভিমত)। সত্যজিৎ রায় কিন্তু নিজের কথা একেবারেই লিখে জাননি। তাই বাঙ্গালির কাছে সত্যজিতের লেখা একটি খাজানা। আমি একবার এক সাহেবকে সত্যজিতের ইংরেজিতে অনুবাদ করা লেখা পড়িয়েছিলাম । খুব বেশি ইমপ্রেসড হয়েছিল বলে মনে হল না। "ক্লেভার প্লট" বলে নিজের বন্ধুত্বের দায়বদ্ধতা সেরে ছিলেন বলেই মনে হল। তার কারণ তাদের নিজেদের জগতে এরকম মৌলিক চিন্তাভাবনা করা লেখক প্রচুর। বরং সেটাই বোধয় প্রথা।

সত্যজিতের বাংলা অবশ্য আমার কাছে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। সেটাকে তো আর ট্রান্সলেট করা যায় না।

শিব্রাম চকত্তি যেমন বাঙ্গালি ছাড়া আর কারো কাছেই ধরা পরবেন না। অথচ তার অনেক কাহিনির লেখক আসলে মার্ক টোয়াইন। যখন পরে মার্ক টোয়াইন পড়লাম, তখন ভারি দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু আবার কিছুদিন পরেই শিবরামের আশ্রয় নিতে হয়েছে। শিবরামের মুনশিয়ানা ভাষায়, সেটা বাঙ্গালিদের পক্ষেও নকল করা অসম্ভব প্রায়। আবার এডভেঞ্চার পড়ার জন্য বিদেশি লেখক ছাড়া কোনও গতি নেই তেমন। বাঙ্গালিরা এমনই এক হতভাগা জাতি, যারা অন্যের কৃতিত্বকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করাটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে ফেলেছে। এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের নিয়ে আমরা হাসাহাসি করি। উচ্চাকাঙ্খি মানুষ বাংলা সিনেমায় খিল্লির পাত্র। তারা শেষে সুখেন দাসের মত এক সর্বহারার পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করে। জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে  পড়ে। এদেশে যত তুমি হারবে ততই তুমি মহান। শেষমেশ তো মরতেই হবে, তাই জন্ম থেকেই মৃত্যুর কথা চিন্তা কর, আর নিজেদের লেখায় সেই সবই বেশিবেশি করে ঢোকাও। তাতে তোমার বুদ্ধিজীবী বলে বেশ নাম হবে। বউ গালি মারতে গিয়ে একটু হোঁচট খাবে আগে। শেষে যখন গালি মারবে, তখন কিছু কাঁচা শব্দ বাদ যাবে এই যা। হাততালিও পাবে গ্রামের মেলার শুরুর দিনে সাহিত্য সভায়। মালা-শাল পরা হয়ে গেলে, গালভরা বক্তৃতায় ক্ষেত মজুরের বাচ্চাকে সাম্যবাদের কথা শিখিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এস খানিক পরে। তারপর একেবারে সামনে বসে "পাগলূ ডান্স" কম্পিটিশন দেখো রাতের ডিনার খাবার ডাক আসা অবধি।

নেহাত লোকেদের নাম নিয়ে, বা একদম একজ্যাক্ট ঘটনার বিবরণ করা যায় না বলে (সেটা তাহলে সাংবাদিকতা হয়ে যাবে, সেটার অবস্থা আরও খারাপ) হাল্কা একটু কল্পনার আশ্রয় নিয়ে এদিক ওদিক বদলে দাও কায়দা করে, ব্যাস, তোমার লেখা তৈরি।

বেশি কল্পনা করতে গেলেই দেখবে তুমি একটি ছাগল, চোখ বন্ধ করে ঘাসের সাথে প্লাস্টিক চেবানই তোমার চরিত্র।    

যেটা বলছিলাম। আমার মতে, কুঁড়ে বাঙ্গালির উচিত এখুনি "যা জান তাই লেখ" বন্ধ করা। কোনও বাঙ্গালি লেখক এখন কল্পনার আশ্রয় নিতে চায় না। কল্পবিগ্যানে দেখছি নতুন কিছু লেখা আসছে, কিন্তু সেখানেও কল্পনার ভারি অভাব। বোঝা যায় বাঙ্গালির কল্পনাশক্তি তলানিতে এসে থেকেছে।  আমার এখন আর এ বিশয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আমি কোনদিনই নিজের কথা লিখতে চাইনি। সেই কারণে কোনও উপন্যাস, গল্প সেরকম ভাবে লিখি না। আমি কোন হরিদাস পাল যে আমার কথা তোমায় শুনতে হবে? 

কিন্তু ভাবছি এবার যা জানিনা সেটা লিখব। দেখি গল্প বেরয় কিনা হাত থেকে। বোঝা যাবে আমার বুদ্ধির দৌড় কদ্দুর। আসল কথা হল লেখার জন্য খাটতে হবে এবার। ভাবার খাটনি,  লেখার খাটনি দুটোই।

ইন্টারনেটে একটা দারুণ আর্টিকেল পড়লাম এই "যাহা জান তাহা লেখ" বিশয়ে, ইংরেজিতে বিখ্যাত লেখকদের বিভিন্ন মন্তব্য বিষয়টির ওপর। লিঙ্ক এই নিচেঃ

https://lithub.com/should-you-write-what-you-know-31-authors-weigh-in/

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...

হাবিজাবি ১

আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ।  সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে।  বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া।  বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্ম...