করোনা ভাইরাস পরবর্তী জীবন কেমন হবে জানা নেই, তবে মনে হয় না তড়িঘড়ি খুব একটা ফের বদল কিছু ঘটবে। মানুষ আবার বাজার দোকানে ভিড় করবে, লোকেরা আবার তাদের বড় বড় গাড়ি নিয়ে রাস্তা দখল করে চলবে। মানুষ আবার লাখে লাখে ডিজেল গাড়ী কিনবে। হওয়াতে বিষের পরিমান আবার বাড়বে। অনেকেই হয়তো বলবেন সাধারণ মানুষের দোষ কোথায়, সরকার থেকেই তো যথেষ্ট পরিবেশ সচেতনতা দেখানো হয়নি। একটা দেশের সরকার যা করে, নাগরিক তার পালন করে, এটাই নিয়ম। তাহলে তর্ক উঠতেই পারে যে সরকার কি ভিন্ন একটি প্রাণী, তাদেরকে তো মানুষই নিয়ে এসেছে, কাজেই তারা মানুষের থেকে আলাদা ভাববে কি করে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মানুষ যতক্ষণ না নিজে বদলায়, ততক্ষন কোনো সরকার বদলাতে পারে না। সেটা বিদেশে গিয়ে আমার দিব্বি উপলব্ধি হয়েছে। পাশ্চাত্যে সরকার এমনি এমনি নিজের মানুষদের নিয়ে এতো চিন্তিত নয়, তার বড় একটা কারণ মানুষ সেখানে জীবন নিয়ে আশাবাদী, এবং নিজের জীবনটাকে কি করে আরো সুন্দর,আরো সচ্ছল এবং সহজ করা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো ভাবনা চিন্তা করে। ব্যক্তি স্বাধীনতা সেখানে চরম, কারণ যে সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতার অবকাশ দেবে না, সেই সরকার আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আমাদের ভারতবর্ষে সেরকমটি নয়। আমরা কিছুটা নৈরাশ্যবাদী, ফ্যাটালিস্টিক -- মানে ভাগ্যে বিশাসী। আমরা মনে করি কপালে যা আছে তাই হবে, তাহলে আর পরিশ্রম করে বিশেষ লাভ নেই। তদুপরি, আমরা পরিবর্তনে বেশ ভয় পাই, এর কারণ হয়তো আমাদের পাঁচ হাজার বছরের অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশ আমাদের তুলনায় অনেক বেশি নবীন, তাই তারা এক্সপেরিমেন্টেশন করতে ভয় পায় না।
যাক, যেটা বলছিলাম। কোরোনা পরবর্তী পৃথিবীটা কেমন হবে তা নিয়ে একটা ধূসর আইডিয়া মাথায় দানা বাঁধছে ক্রমাগত। আমার কেমন জানিনা মনে হচ্ছে, একটু সময়ের পর, প্রায় দশ বছর পর, পৃথিবাটা অনেকটাই বোধয় বদলে যাবে। কিন্তু সেই বদল ভারতবর্ষ, বা কোনো ডেভেলপিং ইকোনমি থেকে আসবে না। সেই বদল আসবে পাশ্চাত্য থেকে। তার মূল কারণ, পশ্চিমের দেশ আমাদের থেকে অনেক বেশি ভুগেছে, তারা আর আগের জীবনে ফিরে যাবে না। ইতিহাস সাক্ষী আছে, তারা প্রতিটি বিপর্যয়ের পর নিজেদের বদলে নিয়েছে, আগের জীবনে আর ফিরে যায় নি। আবার, পশ্চিমে যেটা হয়, সেটাই এখন সারা পৃথিবীর নিত্যকরণীয়। যারা মনে করে আমাদের দেশের অন্য কাউকে দরকার নেই, আমরা নিজেরাই নিজেদের অর্থনীতি সামলে নিতে পারি, তারা ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। আমাদের দেশে ডিমান্ড অনেক, সাপ্লাইও প্রচুর, কাজেই ইকোনমিক্সের কথায় আমরা অনায়াসে 'ডিকাপল্ড', এই ছিল যুক্তি। এই ভাবনাচিন্তা বিগত ক্রেডিট ক্রাইসিস এর সময় খুব চলেছিল। সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে তখন গভীর ধস, কেবল আমরাই নিজের মতো দিব্বি গান গাইতে গাইতে প্রমোদভ্রমণ করছি। তারপর জানা গেলো, আমেরিকার যদি সর্দি লাগে, সারা পৃথিবীকে হাঁচতে কাশতে হয়। ভারতবর্ষও কাশতে আরম্ভ করলো। যাক গে, সেসব অনেকদিন আগেকার কথা। সেসব এখন আলোচনা করে লাভ নেই। মোদ্দা কথাটি হলো ভারতবর্ষ ডিকাপল্ড নয়, এই বিস্সায়নের জমানায় একা বেঁচে থাকা যায় না। অর্থনীতি সারা পৃথিবীকে চালিত করে, এবং তার মক্কা এখন আমেরিকা সহ অন্যান্য পাশ্চাত্যের দেশগুলি, তারাই মানব সভ্যতার আচার আচরণ ঠিক করে দিচ্ছে, তাদের তৈরি করা নিয়মই এখন বেঁচে থাকার বিধান।
এবং সেই পাশ্চাত্য দেশের মানুষগুলি এখন আর আগের মতো গায়ে ঘেসাঘেসি করে চলাফেরা করতে চায় না। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ শুধুমাত্র কোবিদ এর সময় নয়, এটাই হোক সামাজিক নিয়ম, এই তাদের দাবি। মানুষ যেভাবে প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে, এখন আর পরস্পরের কাছে পা চালিয়ে যেতে হয় না, বোতাম টিপেই মুখোমুখি পৌঁছে যাওয়া যায়। এখন সবাই ইন্টারনেট এ চলে আসতে চায়। পাশের বাড়ির মানুষটার সাথে কথা তারা আগেই ফোনে বলতো, এখন টাউনহল এর মিটিং, বা চার্চের সার্মন লাইভ ভিডিও স্ত্রীইমেই হোক, এই তারা চায়। ভগবান যীশু হৃদয়ে থাকুন, আর থাকুক বাড়ির সাজানো তাকে। তাকে দেখতে চার্চে ভিড় করার কোনো দরকার নেই। মানুষ মানুষ কে দেখবে একটা পর্দার পিছনে, স্ক্রিনের মধ্যে থেকে। একটু গভীরে ভেবে দেখলে, এইটা মানবজাতির পক্ষে এক বিরাট পরিবর্তন। আমরা আর মৌমাছির মতো সামাজিক প্রাণী হয়ে থাকতে চাই না। এটা একটা ব্যবহারগত পরিবর্তন, যার ফল সুদূরপ্রসারী এবং আমূল পরিবর্তনকারী। কোবিদ হলো 'চেঞ্জ এজেন্ট', ইংরেজিতে বললে। 'সাইলেন্ট রেভোলুশন', মনোস্তত্ববিদরা বলবেন, বলছেনও।
মানুষ যেমন যেমন অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়বে, একে ওপরের সাথে দূরত্বের কথা মাথায় না রেখে, দেশের রাজনৈতিক নিয়ম কানুন পরোয়া না করে (পাসপোর্ট-ভিসা) মুহূর্তে পরস্পরের সাথে দেখা করবে, দেশ ব্যাপারটার সংজ্ঞার ঘটবে আমূল পরিবর্তন। এক দেশ অন্যের সাথে মিশে যাবে, দেশ ব্যাপারটা আমাদের জানা দেশ না থেকে অনেক বড় একটা সত্তা হয়ে দাঁড়াবে। দেশ একটা ফিজিক্যাল বাউন্ডারি, সেটাই যখন ভার্চুয়াল হয়ে যাচ্ছে, তখন দেশের সীমানাটাও অনেকটাই ভার্চুয়াল হয়ে যাবে আসতে আসতে। আমার পরিচয় ভারতবাসী বলে নয়, আমার পরিচয় হয়তো হবে আমি ভারত বলে কোনো অনলাইন গ্রুপের মেম্বার কিনা তার ওপর। তবে ফিজিক্যাল বাউন্ডারি যে একেবারে ভেঙে যাবে আমি তা বলছি না, কিন্তু সেটা আজকের মতো এতো ধ্রুবসত্য হয়ে থাকবে না। এরপর আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি বেরোবে, আমাদের জীবন চালিত হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা। হয়তো কোয়ান্ট যাবহার করে আমরা কলকাতায় একটা দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে, সেই দরজা খুলে বেরোবো আমেরিকার নিউ-জার্সির কোনো একটা বাড়িতে। হতেই পারে, থিওরি তৈরি করা আছে, বাস্তবায়িত করতেই যা সময় লাগে। কিন্তু সেটা হতে অবশ্যই এখনো অনেক দেরি, অথবা কে জানে, হয়তো দেরি নেই। পৃথিবীটা তো এমনি দূর-দাড় করেই বদলে যায়।
আর এই ইন্টারনেট যদি বিদেশের জীবনের অনির্বচনীয় অঙ্গ হয়ে ওঠে, জল বা অক্সিজেনের মতো একটা কিছু, তাহলে খুব দ্রুত ভারতবাসীদেরও বদলে যেতে হবে।আমরাও আসতে আসতে ঘরের ভিতর সেঁধুতে আরম্ভ করবো। আমাদের ঘরে জায়গার অভাব বলে বাচ্চা-কাচ্চা কম হবে। শহর গুলো ভেঙে যেতে আরম্ভ করবে, মানুষ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে, আমাদের জেনেরেশনের মতো বাংলা ছেড়ে মহারাষ্ট্রতে খুব কম মানুষ আসবে। ভারতবর্ষ থেকে বিদেশেও মানুষ আর আগের মতো যাবে না। যদি আমি বাংলার কোনো গ্রামে বসে নিউয়র্কের কোনো টেকনোলজি কোম্পানির হয়ে কাজ করে দিতে পারি, তাহলে আর রাত্রে ক্লাবের আড্ডা বা কেরামবোর্ডটা ছাড়বো কেন? ওয়ার্ক ফ্রম হোম তখন ব্যতিক্রম নয়, সেটাই হবে নিয়ম। শহরের প্রাধান্য কমে আসার সাথে সাথে আমাদের রাজনীতি বদলে যাবে। খেটে খাওয়া শ্রেণী বিলুপ্ত হবে না, তারা থাকবে, কিন্তু হয়তো মেশিন এসে তাদের কাজ অনেক কম করে দেবে, তাদের প্রয়োজন অনেকটাই কমিয়ে দেবে। সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে, সবাইকে ইন্টারনেটের যোগ্য হতে হবে। যুদ্ধ আর মানুষ মারার খেলা হবে না, যুদ্ধ হবে মানুষকে অর্থনৈতিক ভাবে সর্বশ্রান্ত করার এক খেলা। জনসংখ্যা প্রচুর হওয়ার কারণে, মানুষ আর মানুষের দুঃখে সমব্যাথী হবে না, যাদের সব শেষ, তাদের বাঁচিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করা হবে না, বরং তাদের নিজেদের ঘর থেকে বের করে দেয়া হবে। যারা ইন্টারনেটের দুনিয়ার সাথে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়, বরন করে নিতে হবে চরম দারিদ্র ও ধীর মৃত্যু।
তবে এতটা হতে সময় লাগবে আরো প্রায় বছর তিরিশেক। ইতিমধ্যে মানুষ যেমন যেমন ঘর থেকে কাজ করা শুরু করবে, এবং আর পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে শহরে মানুষের ভিড় কমতে শুরু করবে, সেটা হবে বিগিনিং অফ দা এন্ড, শেষের শুরু। তাতে ভালো যেমন আছে, ক্ষতিও প্রচুর। অনেকেই যেমন বোঝেন না শহর না থাকলে অর্থনীতি এতো বেহাল হতে শুরু করে যে গ্রামের বেখায়ালা ঘুরে বেড়ানো ছেলেটার পেটেও টান পরে, কিন্তু সেসব জটিল তথ্য, এই ব্লগ পোস্টার যোগ্য নয়।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, নিজের চোখে প্রতক্ষ্য করছি মানবজাতির বদলে যাওয়ার দিনগুলি। ২০১৯ এর জীবন আমাদের কাছে অতীত, আর কোনওদিন হয়তো ফিরবে না। বা ফিরলেও সেটা অভ্যাসবশত। সেটা প্রদীপ নেভার আগে শিখার চমকে ওঠার মতো। আমি দেখছি, দেখবো, আরেকবার একটা নতুন ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো।
মন্তব্যসমূহ