এপ্রিল মাসের সাত তারিখে আমি আমার নতুন কেনা সুটকেস নিয়ে মুম্বাই এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। প্রথম বার বিদেশের মাটিতে পা রাখবো। তাও আবার ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। মনের মধ্যে একটা ঢিপঢিপানি যে ছিলনা তা বলবো না, কিন্তু আমি খুব একটা বেশি কিছু উত্তেজিতও ছিলাম না।
আমার সারা জীবন ধরে, আমার প্রতিটি মুহূর্ত জুড়ে আছে এখন আমার মেয়ে। তাকে ছেড়ে সাত দিন থাকতে হবে ভেবে ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। আরও মনে হচ্ছিলো, মেয়েটা আমাকে ছেড়ে থাকবে কি করে। আমার ভুঁড়ির ওপর পা তুলে তবেই তার ঘুম। রাত্তিরে জেগে থাকে আমার অফিস থেকে ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে।
অবশ্য ওর খারাব থাকার কথা নয়, ওর মা তো আছেই, সাথে আছে ওর পুয়া, মানে আমার মা, আমি যাবার প্রথম দুদিন আমার বাবাও থাকবেন । ওনারা কোন্নগর থেকে এসেছেন আমাদের সাথে দিন কাটাবে বলে আর তার সাথে আমার অনুপস্থিতে আমার পরিবারের সাথে থাকতে।
আমার সারা জীবন ধরে, আমার প্রতিটি মুহূর্ত জুড়ে আছে এখন আমার মেয়ে। তাকে ছেড়ে সাত দিন থাকতে হবে ভেবে ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। আরও মনে হচ্ছিলো, মেয়েটা আমাকে ছেড়ে থাকবে কি করে। আমার ভুঁড়ির ওপর পা তুলে তবেই তার ঘুম। রাত্তিরে জেগে থাকে আমার অফিস থেকে ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে।
অবশ্য ওর খারাব থাকার কথা নয়, ওর মা তো আছেই, সাথে আছে ওর পুয়া, মানে আমার মা, আমি যাবার প্রথম দুদিন আমার বাবাও থাকবেন । ওনারা কোন্নগর থেকে এসেছেন আমাদের সাথে দিন কাটাবে বলে আর তার সাথে আমার অনুপস্থিতে আমার পরিবারের সাথে থাকতে।
তবু, স্বার্থপরের মতো ভাবতে ভালো লাগে আমি না থাকলে মেয়ের খুব কষ্ট হবে। আমি সাংবাদিক, সামান্য মাইনেতে মুম্বাই তে ঘর করে উঠতে পারিনি, অনেক দূরে ডম্বিভ্লি নামক শহরতলিতে আমাদের থাকা। অফিস থেকে রাত নয়টার আগে বেরোনো হয়না, বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সেই রাত ১১ টা ১১.৩০।
আমি ফিরলে আমার সাথে অনেক কথা তার। সিংহভাগটাই অবশ্য এই যে তার মা তাকে বকেছে, বা মেরেছে। ওর মা যদিও ওকে কোনোদিনই মারে না। আমি যে বরঞ্চ এক আধবার ধৈর্য হারাইনি তা বুক ঠুকে বলতে পারবো না ।
যাবার ইচ্ছে তো আছেই, কিন্তু পিছুটানও প্রবল। দেখতে গেলে মাত্র সাত দিন, কিন্তু আসলে সাত বছর আমার কাছে । মনে মনে নিজেকে ছদ্ম বোঝাই, এত ভালো অভিজ্ঞতা ছেড়ে কি করে দি? প্রিয়জন তো পিছু টানবেই, তা বলে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। তাছাড়া, যদি একবার আমেরিকা ঘুরে আসি এই মুফতে পাওয়া বৃত্তিতে, তাহলে বোধয় আমার চাকরি-বাকরি একটু পোক্ত হবে। প্রাইভেট এ কাজ করি, চাকরি টা এই আছে, এই নেই ...। আমি সেই কারণেও, আমেরিকা যাবার জন্য একটু ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। যারা আমায় চেনে, তারা জানে, আমি ঘুরতে ভালোবাসি না।
মুম্বাই এর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ কোনোদিন আমার আসা হয় নি। কথাটা অবশ্য ঠিক নয়। একই এয়ারপোর্ট, একটা দিক বিদেশ যাত্রার জন্য , অন্য দিকটা দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য। যেই জায়গাটা বিদেশ যাত্রার জন্য নির্ধারিত, সেখানে আমার কোনোদিন ঢোকা হয় নি। নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু কেন জানিনা মনে হলো ডোমেস্টিক টা বোধয় আরো বেশি সুন্দর। এখন আমি বিদেশের দুটো এয়ারপোর্ট দেখে দৃঢ় নিশ্চিত যে মুম্বাই এয়ারপোর্ট অন্য অনেকের থেকে অনেক, অনেক সেরা। আবু ধাবি তো প্রায় পুরোনো ব্যাঙ্গালুরু বা পুরোনো কলকাতা এয়ারপোর্ট এর মতোই, তার বেশি কিছু নয়।
কিন্তু এই সব এয়ারপোর্টে যা বড় বড় সব উড়োজাহাজ দেখলাম, তাতেই আমার পয়সা উসুল। জীবনে প্রথমবার এয়ারবাস এ-৩৮০ দেখলাম। কি যে আনন্দ হলো দেখে, কি অদ্ভুত সুন্দর বিরাট এক পাখি, ঝুপ করে এখনই বুঝি টেরোডেক্টাইলের মতো ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাবে। ভেবে কষ্ট হলো এতো সুন্দর জাহাজটা আর তৈরি হবে না। আমার হয়তো কোনোদিন দুটো আইকনিক প্লেন বোয়িং ৭৪৭ আর এ -৩৮০ তে বসা হবে না। কুছ পরোয়া নেহি, কপালে থাকলে হবে। কোন্নগরের বাজে রেজাল্ট করা ফাঁকিবাজ ছেলে আমেরিকা যাচ্ছি, তাও একটা শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি নিয়ে, এর থেকে বেশি কপালের জোর আর কি হতে পারে।
আমার যাবার পথ হলে মুম্বাই থেকে আবুধাবি, আবু ধাবি থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। এখন থেকে বোয়িং ৭৭৭, আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৭৮৭ -- উফফ!
আমার টিকেট হয়েছিল ইতিহাদ এয়ারলাইন্সএর। এই সেই বিখ্যাত বোয়িং ৭৭৭ প্লেন , শুনেছি একবিংশ শতকের সেরা উড়োজাহাজ হয় । আমার স্বপ্নের জাম্বোজেট ৭৪৭ না হলেও চলবে। শুনেছি ৭৪৭ নাকি এখন খুব কম চলে। অনেক খরচ তাতে, প্রচুর তেল খায়, তাই আর কেউ তা কেনে না নতুন করে। যাদের আছে তাদের আছে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমার কোনো আন্দাজ ছিল না যে এই উড়োজাহাজের মধ্যে তিন চারটে আলাদা ঘর থাকে। বিজনেস ক্লাস জানতাম ঠিক, সেটা ৭৩৭ বা এ-৩২০ তেই দেখেছি, কিন্তু এই বড় প্লেন গুলোতে একটা থাকে বিসনেস ক্লাস, একটা ফার্স্ট ক্লাস, এবং দুটো না তিনটে ইকোনমি ক্লাস। ইকোনমি ক্লাস এ আবার এক সারিতে দশজন করে লোক বসে, অন্তত ৭৭৭ এ তাই নিয়ম। পরে অবশ্য দেখলাম ৭৮৭ এ ৩-৩-৩ হিসাবে লোক বসছে। আমার টিকিট টা সব থেকে সস্তার ছিল, তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। একটা ডলার ও আমি নিজের পকেট থেকে বের করিনি। সম্পূর্ণ মুফতে কিছু পেয়েও যারা অভিযোগ করে, তাদের আমার পৃথিবীর এক আশ্চর্য বলেই মনে হয়।
বলাই বাহুল্য, এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেক খুব কড়া। আমার পায়ে ক্যানভাসের জুতো, তাই বর্তে গেলাম, নয়তো বাকি সবাইকে জুতো খুলে ট্রে র ওপর রাখতে হচ্ছিলো। আমাকে বেল্ট খুলে ফেলতে বলা হলো। তারপর একটা ইমিগ্রেশন এর লম্বা লাইন। পরিষ্কার করে লেখা এখানে ছবি তোলা মানা। ইমিগ্র্যাশন অফিসারদের সাথে তর্ক করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা, সেটাও স্পষ্ট করে দেয়া। ইমিগ্রেশন পার করে মুম্বাই এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি জোন। সেখানে হরেক রকম জিনিসপত্র সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। আমি একটা কলম কেনার চেষ্টা করলাম, দেখলাম সেটা ডিউটি ফ্রি নয়। আর বাকি কিছু কেনার কোনো মানে হয় না, সেসব ফেরার সময় কেনে লোকেরা।
ভেবেছিলাম সিগারেট ছেড়ে দেব, কিন্তু ডিউটি ফ্রি তে ঢোকার সময় গলাটা খুস খুস করতে শুরু করলো। একটা দোকানে দেখলাম থরে থরে সিগারেট সাজানো। আফসোসের কথা আমার নিজের ব্র্যান্ড পেলাম না। এরা নাকি শুধুমাত্র বিদেশী সিগারেট রাখে। আমি কিনলাম এক কার্টন ডানহিল ৭ এমজি। তাতে ২০ টা সিগারেটের দশটা প্যাকেট। ২০০ টা সিগারেট নিয়ে যাওয়ার ছূট আছে আন্তর্জাতিক নিয়মে। তারপর অনেকটা পিছু হেঁটে স্মোকিং রুম। ঢুকে দেখি এক গুচ্ছ গুজরাটি। তারা সবাই নিজের ভাষায় কথা বলছে আর এমনি সপ্রতিভ যে বোঝা যাচ্ছে এরা মাঝেমধ্যেই বিদেশ যাত্রা করে। সাজ পোশাক খুবই সাধারণ, মনে হচ্ছে লোকাল ট্রেন ধরবে এক্ষুনি। এরাই বোধয় ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব ডায়মন্ড মার্চেণ্টস। এদের এক এক জন কোটি কোটি পতি, জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ। আমার বন্ধু মেহুল শাহের মতে , গুজরাটি বানিয়ারা জন্মাবার পর থেকেই চিন্তা করতে শুরু করে কি করে পকেটের ১ টাকাটাকে ২ টাকা বানানো যায়, দুই কে চার। বাঙালি যতই ভান করুক সে সরস্বতীর পূজারী, লক্ষীর নয়, গুজরাটির থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। মূলত, যে কাজ টা তুমি স্বধর্ম বলে মেনে নিয়েছো, তাকে এত ভালো করে করো যে পৃথিবীটা একদিন পায়ের তলায় চলে আসে। শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধির জোরে, ব্যবসার খাতিরে এরা বিশ্বভ্রমণ করে অবহেলায়, নিতান্তই যেন পেটের তাগিদে। দেখে ভালো লাগলো, বিস্মিতও হলাম কিছু কম নয়।এক সাহেবকেও দেখলাম স্মোকিং রুমে, জুল জুল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে আর শুনছে কিভাবে অবহেলায় কোটি কোটি টাকার লোকসান নিয়ে মানুষগুলো হাসাহাসি করছে।
ধোয়া ছাড়া শেষ করে ওয়েটিং এরিয়ায় গিয়ে বসে থাকলাম, দেখি সুন্দর শোবার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রচুর লোকজন অর্ধশায়িত হয়ে রয়েছে। একজন প্রৌঢ়ার সুটকেসে বড় বড় করে লেখা তার গন্তব্যস্থানে ঠিকানা। অমুক মশাই, তমুক রাস্তা, ইলিনয়, আমেরিকা। ছোটবেলায় জম্মু তাওয়াই বা পূর্বা এক্সপ্রেসে মামা বাড়ি গয়ায় যাওয়ার সময় বাঙ্কারের নিচে দেখতাম সহযাত্রীদের লোহার তরঙ্গে লেখা 'দিল্লী, চানক্যাপুরী'।
একটু ঘুম ঘুম পেয়েছিলো বটে, সেই সকাল ৫ টাতে ফ্লাইট, বাড়ির থেকে বেড়িয়েছি রাত দশটায়। কিন্তু যদি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দি তাহলে আর এতদূর এলাম কেন? প্লেনে বসে না হয় ঘুমিয়ে পড়া যাবে। আমার দেশ দেখার শখ কোনোদিনই ছিল না. শুধু একটু কৌতূহল আছে যে পঞ্চভূতে আমার দেখা পৃথিবীটা তৈরি, সেই পঞ্চভূত কে পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম? আমেরিকা একটা আদর্শ জায়গা তা দেখার, কারণ সেটা একেবারে আমাদের উল্টোদিকে। যখন দেখলাম, তখন বুঝলাম, আমার আর তেমন কিছুই দেখার নেই, পৃথিবী সর্বত্রই একই রকম। শুধু আমেরিকার শহরে মাটি দেখা যায় না, সবটাই পীচ বা সিমেন্ট দিয়ে ঢাকা। তাই বোধয় ধুলো নেই।
প্লেনে একদম শেষের দিকে জায়গা পাওয়া গেলো, এয়ারপোর্টের চেকইন কাউন্টারে আমার সহৃদয় ভারতীয় দয়া করে আমায় এইল সিট দিয়েছিলেন। মুম্বাই থেকে আবু ধাবি, আবার আবু ধাবি থেকে ওয়াশিংটন, দুটো দিকেরই।
প্লেনের পরিচারিকারা কেউই মধ্যপ্রাচ্যের নন, মনে হলো ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশা সব সুন্দরী তন্বী। পরে দেখে মুগ্ধ হলাম কি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় এই বিমানচারিকাদের। ভালো বেতন পাওয়াটা ভালো ব্যাপার, কিন্তু দিনের পর দিন প্লেনের মধ্যে এই পরিশ্রম করাটা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মাটিতে থাকলে অসুবিধে নেই, কিন্তু প্লেনে যাত্রা করাটা খুব একটা সুখপ্রদ নয়। এই মেয়েগুলি সেটাই করে চলে বছরের পর বছর। তবে বিমানসেবিকা হিসাবে খুব নামি এশিয়ার ভদ্রমহিলার। থাই, সিঙ্গাপুর এরা সবার প্রিয়, ভারতীয় বিমান পরিচারিকাও খুব জনপ্রিয় এই সব লম্বা রুট। দেখে, সত্যি কথা বলতে কি, নারীশক্তির প্রতি ভক্তিটা আরেকটু প্রগাঢ় হয়।
এই প্রথমবার ৭৭৭ এ উঠলাম জীবনে। অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতা। এর ইঞ্জিনটাই প্রায় একতলা বাড়ির মতো বড়। দুটো GE -৯০ ইঞ্জিন এই সুবিশাল জাহাজকে আকাশে তুলে দেয় , নিয়ে চলে মহাসমুদ্র, মহাদেশ পার করে দূরে বহু দূরে। কি অদ্ভুত বিস্ময় এই মানুষ জাতি এবং তার আবিষ্কার সমূহ। কোনো অসাধারণ মেশিন দেখলে আমার সেটা কোনো অংশে ভগবানের সৃষ্টির থেকে কিছু কম মনে হয় না। আমি বারংবার নতজানু হই মানুষের সৃষ্টির কাছে, ঠিক যেমন ভগবানের মন্দিরে আমার থুতনি আপনা থেকে বুকে নেমে আসে।
প্লেনটা ছাড়ার বাদে খাবার পরিবেশনা শুরু হলো। পরিচারিকা আমায় ঘুম থেকে তুলে বললেন, আপনি কি 'হিন্দু' খাবার বুক করেছেন? আমি একটু অবাক, হিন্দু খাবার আবার কি? তাছাড়া টিকিট তো আমি কাটিনি, কে কেটেছে জানিনা, এ কি অর্ডার দিয়েছে সেটাও আমার জানা নেই। পরে দেখা গেলো, আমার পাশে বসা দক্ষিণাত্যের ভদ্রলোক সেই হিন্দু খাবারের অর্ডার দিয়েছে, উনি ভেজেটেরিয়ান।
কিন্তু লে হালুয়া, হিন্দু খাবার মানে নাকি আমিষ খাবার! দক্ষিণের ভদ্রলোক তো প্যাকেটটা খুলে প্রায় ৩৯,০০০ হাজার ফিট থেকে লাফ মারেন মাটিতে। যাক, তার জন্য এক নিরামিষ খাবার দেয়া হলো, আমি খেলাম 'হিনডু ' খাবার। আগেই শুভার্থীরা বলে দিয়েছিলো, খবরদার কফি বা ওয়াইন খাবে না, তাহলে ঘুমের দফা রফা। আমি একটি আপেল জুস নিলাম, আর জল। খেতে খেতে দেখলাম রাতের আকাশ ভোর হয়ে যাচ্ছে, মেঘ গুলো প্রথমে তামাটে, তারপর সোনালি আভায় ছেয়ে গেলো, আমি আমার ডান দিকের দূরের জানালার দিকে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম। সেখানে বসা সহযাত্রীকে বললাম একটা ছবি তুলে দিতে।
খেয়েই আবার ঘুম।
ঘুম ভাঙলো এনাউন্সমেন্ট এ যে প্লেন টা এবার ল্যান্ড করবে আবু ধাবি । বিস্তীর্ণ কঠিন মাটির জায়গা, আসলে মরুভূমি বোধয়। বিশাল এয়ারপোর্টে যত্র তত্র দাঁড়িয়ে সুবিশাল সব এরোপ্লেন। যেন আমাদের খেলার মাঠের পাশে সাইকেল রাখা। একটাও ছোট এ-৩২০ বা ৭৩৭ চোখে পড়লো না। ওখানে ডোমেস্টিক রুটেও সব সুবিশাল প্লেন চলে।
এয়ারপোর্টে নেমেই প্রথম ধান্দা আমার একটা সিগারেট টানার। আমাদের মুম্বাইতে এয়ারপোর্টে নেমেই সিগারেট খাবার জায়গা, এখন প্রায় অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে, নেমেই ধোয়া টানতে ইচ্ছে করে। প্রবল নেশা। প্যাসেজ দিয়ে হেটে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি বাংলা কথা। কথার টানে অবশ্য বুঝতে পারি কোনো বাংলাদেশী হবে। দিব্বি জিজ্ঞেস করে নিলাম, আচ্ছা দাদা, সিগারেট খাবার জায়গা আছে এখানে? যেন কলকাতাতেই আছি, এমন ভাবে আমাকে উনি বলে দিলেন হবে, তবে তার আগে ইমিগ্রেশন করে নিলে ভালো হয়। তাতে নাকি বেশ অনেকটা সময় লাগে, সময় নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।
আবুধাবি এয়ারপোর্টেই ইমিগ্রেশন করে নিলাম ইউনাইটেড স্টেটস এর। আমার ইমিগ্রেশন অফিসার ছিলেন এক গুজরাটি পুলিশ অফিসার, তিনি মার্কিন। আমার সাথে দিব্বি হিন্দিতে কথা বললেন, জিজ্ঞেস করলেন বিজয় মাল্ল্যা এবং নীরব মোদির কথা, তারা কি করে দেশ ছেড়ে পালাতে পারলো, তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা, সেসব। আমি একটু সাবধানেই সব জবাব দিলাম, কি জানে বাবা কি বলতে গিয়ে কি বলবো তখন আমার গুজরাটি ভাই মার্কিন সাহেব হয়ে বলবে যা ফিরে যা, আমার দেশে তোকে ঢুকতে দেব না। তার দেশে ঢুকতে খুব যে মুখিয়ে আছি তা নয়, কিন্তু এতো প্রস্তুতি যদি বৃথা যায়?
মিনিট পাঁচেক খেজুরে করার পর ভদ্রলোক বললেন "ওয়েলকাম টু ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা"! আমার পাসপোর্ট এ ছাপ পড়লো "এডমিটেড", সে দেশে আমার ছয়মাস থাকা অনুমিত হলো। অক্টোবর ৬ এর আগে ফিরতে হবে দেশে। আমি অবশ্য ঠিক সাত দিন পরেই ফিরবো।
ইমিগ্র্যাশন করে এসে বাড়িতে ফোন করলাম। মেয়ের সাথে কথা হলো, আমি এখন বিদেশে, মেয়ের থেকে অনেক দূরে। এখন তার কণ্ঠ শোনা বা তাকে ভিডিও কল এ দেখা ছাড়া, তাকে ছোবার আমার আর কোনো উপায় নেই। এটাও যে পারছি, সেটাও যে অনেক বেশি প্রাপ্তি। যে মানুষেরা এরকম এক টেকনোলজি বানিয়েছেন, এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য এতো সস্তায় উপলব্ধ করেছেন, তাদের আমার শত কোটি প্রণাম।
এয়ারপোর্টের স্মোকিং জোনে দিব্বি সিগারেট টানা গেলো। এই কাঁচের ঘরটাই আমাদের ধোয়াখোড়েদের কাছে খুব বড় পাওয়া, বিলাসিতার চূড়ান্ত। কিন্তু স্মোকিং লাউঞ্জ যে কি জিনিস হতে পারে তার সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। সেটা স্টেটস এ গিয়ে দেখলাম চাক্ষুষ এবং দেখে মুগ্ধ হলাম। বিশাল একটা ঠান্ডা ঘরে রীতিমত আরামদায়ক গদি দিয়ে মোরা চেয়ার পাতা। সেখানে মানুষ চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিয়ে জমিদারের মতো ধোয়া টানছে। পাশ্চাত্য দেশ এমনি এমনি এতো উন্নতি করেনি। তারা তাদের মানুষকে, মানুষের ইচ্ছেকে অনেক গুরুত্ব দেয়। অবশ্য বাকি পৃথিবীকে তারা কি ভাবে সে বিষয়ে খুব ভালো মন্তব্য করা যায় না। চাঁদেও বোধয় এতো গর্ত নেই, যত আছে পৃথিবীর বুকে আমেরিকার বোমা দিয়ে আঁকা। মার্কিন ছাড়া বাকি পৃথিবীর মানুষ বুঝিবা শুধুই নম্বর।
নির্ধিষ্ট সময়ের প্রায় দেড় ঘন্টা পরে মাইকে ঘোষণা হলো, ওয়াশিংটন যাওয়ার জন্য যাত্রীরা এবার বিমানে এ উঠতে পারেন। উঁকি দিয়ে দেখলাম আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে এক ড্রিমলাইনার -- বোয়িং ৭৮৭!
মন্তব্যসমূহ