সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছোটবেলার পরীরা

যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন দূরের ল্যাম্পোস্টের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা আমাদের খুব প্রিয় এক এডভেঞ্চার ছিল। আমি আর আমার বোন গুড়ি সুড়ি মেরে রাত্রিবেলায় উঠে পর্দাটা সরিয়ে গাল ঠেকাতাম জানালার শীতল লোহার গ্রিলে।  
বাবা মা অঘোরে ঘুমাতো, কিন্তু আমরা দুজন ঠিক উঠে পড়তাম কোনো এক অজানা কারনে। দূরের ল্যাম্পোস্টের আলোটা বোধয় আমাদের ভেতর এক এলার্ম ঘড়ি জাগিয়ে তুলতো। 
নিজেদের খুদে শরীরগুলোকে জানালার লোহার গ্রিলের সাথে চিপকে দিয়ে, চোখের দৃষ্টিকে ছুড়তাম অনন্তের দিকে। ল্যাম্পোস্ট গুলো সকালে কেমন বিচ্ছিরি পাতাছাড়ানো তালগাছের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে গেলে হঠাৎ করে তারা যেন প্রাণ পায়। একে ওপরের সাথে তারা আলো ছুড়ে কথা বলে। আমরা চোখ টেনে চেষ্টা করতাম একদম শেষের পোস্টটা দেখার। জানতাম, বৃথা সে প্রচেষ্টা। তবু, মানুষদের পৃথিবীটা যেখানে শেষ হয় আর বেম্মদত্তি বা শাঁকচুন্নির দুনিয়া যেখান থেকে শুরু, সেই প্রায় ব্রজদাদের আমবাগান অবধি দৃষ্টি টেনে শেষে তন্ময় ভাবে তাকিয়ে থাকতাম মিটার সয়েক দূরের আমাদের সোজাসোজি আলোটার দিকে। তার পাশেই বাঁশবাগান, তারপ রাস্তাটা বেঁকে বাম দিকে রওনা দিয়েছে। জোছনার আলোয় নির্জন পীচের রাস্তা চকচক করতো, ল্যাম্পোস্টের নিচে ঘন হয়ে থাকতো গোল, হলুদ আলো।  
পৃথিবীর এমন কোনো রহস্য ছিল না যা আমার অজানা ছিল, আর এমন কিছুই ছিল না যা ঝুমুর জানা ছিল।  ঝুমু আমার বোন, আমার থেকে দেড় বছরের ছোট। ওর বোধয় তখন পাঁচ বা ছয়, আমার মেরেকেটে সাত, সাড়ে সাত।  
কিন্তু ওই ল্যাম্পোস্টের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই যেন সম্মোহিত হয়ে যেতাম। ঝুমুর মনে কোনো প্রশ্ন জাগতো না। হয়তো জাগতো বা, কিন্তু সেটার উত্তর যে তার সবজান্তা দাদার কাছে নেই, সেটাও সে জানতো। 
আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন সেই হলুদ আলোর নিচে কোনো ডানাওয়ালা পরী নেচে উঠবে। খেয়ালটা মাথায় জাগতে অবশ্য বুকটা ছ্যাৎ করে উঠতো। জানালার গ্রিলটাকে জোরে টেনে পরখ করে নিতাম সেগুলো যথেষ্ট পোক্ত কিনা। কিন্তু যদি ভূত দেখতে পাই? আর ভূতটাও যদি আমাদের দেখে ফেলে? পর্দাটা একটু টেনে নিয়ে নিজেদের আড়াল করে নিতাম।  
কোনো পরী দেখেছি বলে মনে পরে না, ঝুমু দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। ভূতও বোধয় দেখাটা কপালে ছিল না।  কি যে দেখেছিলাম, আর কেন যে জেগে থাকতাম, তা আজ আর বলে উঠতে পারবো না।  তখন লিখে রাখা উচিত ছিল।  কিন্তু লিখতেও তো ছাই পারতাম না তখন।  
অবশ্য, সব বাচ্চারাই লেখার একটা বিকল্প জানে। তারা সকালে উঠে, বা দিনের শেষে, মাকে জড়িয়ে সব কথা আউড়ে দেয়।  ওটাই তাদের রেকর্ড করা। সেই শ্রুতিকবিতা বহুকাল পরে মা তাদের শুনিয়ে দেন।  তখন বাচ্চারা সবাই বড় হয়ে গেছে, প্রায় তাদের সেই ছোটবেলার দেখা মায়ের মতো বড়।  
তাদের মা এখন হয়ত বা ঠাকুমা। নাতি নাতনিকে বাবা মার ছোটবেলার কাহিনী বলেন ঠাকুমা, কানে ভেসে আসে সেই কথা, তাদের নিজেদের কথা, সে এক আশ্চর্য জগতের কথা। শুনলে বিশ্বাস হয় না। কেউ সেসব লিখে রাখে, কেউ আবার সেগুলোকে শ্রুতিকবিতাই রেখে দেয়, নিজের মনের মাঝে সুখী একটি মুক্তোর মতো।  
কিন্তু আমরা কোনোদিন মাকে আমাদের এই ছোট্ট রহস্যের কথা জানাই নি। জানালেই যদি সব শেষ হয়ে যায়, আর যদি কোনোদিন না বসতে পারি জানালার ধারে।  
আজ যখন সব বিস্ময় শেষ, এখন যখন অনেক জেনে জানতে পেরেছি পরী বা ভূতেদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানার নেই, তখন নিজের ওপর খুব রাগ হয়।  
মনে হয়, কেন সেই রাত গুলোতে ঘুমিয়ে পড়তাম? আরেকটু জেগে থাকলে কি সত্যি পরী দেখতে পেতাম না? 
কিন্তু, আমরা ঘুমিয়েই বা পড়তাম কিভাবে? 
তাহলে কি সত্যি সত্যি পরীরা আসত আমাদের কাছে? আমি যে ছোটবেলায় পড়েছি, পরীরা যাবার আগে তারার গুঁড়ো ছিটিয়ে ঘুম পাড়িয়ে যায়, আগের যা কিছু স্মৃতি সব বিলুপ্ত করে আবার তারা ভোরের কুয়াশায় মিলিয়ে যায়।  
কে জানে। 
আরেকবার যদি সেই বিছানাটা, সেই পদ্মফুলের কাজ করা লোহার গ্রিল দেয়া জানালাটা, সেই পর্দাটা, আর সেই ল্যাম্পপোস্টটা পেতাম, তাহলে একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করতাম।  আমার বিস্ময় যে আজো বেঁচে আছে, শুধু তাকে লুকিয়ে রাখি, লুকিয়ে রাখতে হয় লজ্জায়, বড় হয়ে গেছি বলে।  
x

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...

হাবিজাবি ১

আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ।  সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে।  বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া।  বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্ম...