সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছোটদের জন্য


আমাদের ছোটবেলায় পৃথিবীটা ছিল অন্য রকম। বাবা মা রা যথেষ্ট সাংঘাতিক ছিলেন, আর পাড়ার কাকু কাকিমা, জেঠু জেঠিমা ও দাদারা ছিলেন পাক্কা খুনে। দিদিরা তবে ছিলেন মায়ের মত. মানে, মারা যখন ভালো থাকেন,  তেমন। 


এই যেমন ধরো তুমি  ইশ্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে গুলি খেলছ বাশবাগানের ঝোপের  আড়ালে, অমনি কোত্থেকে এক দাদা এসে হাজির। 

সে যদি আমাদের শুধু শাসন করেই খান্ত হত, সেটাও না হয় সহ্য করে নেয়া যায়, মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকা বই তো আর কিছু নয়, কিন্তু সেই দাদা যখন জুলফি ধরে টান দেয়, সেটা প্রানান্তকর একটা কঠিন ব্যাপার।  আবার যদি উল্টে বলতে যাও, তুমিও তো এখানে বিড়ি খেতে এসেছিলে, তার বেলা? সে তাহলে তোমার এমন ধানাই পানাই করবে যে সে রাত্রে জ্বর যদি না আসে, তাহলে কপাল ঠুকে একটা ভাগ্যলক্ষী লটারির টিকেট কিনতে পারো। কোটিপতি হওয়া কেউ রুখতে পারবে না।  

পাড়ার কোনো কাকুর হাতে পড়লে তো আরো  বিপদ।  তোমাকে সিধে উনিশের নামতা জিগ্যেস করে বসবে নয়তো 'সরস্বতী' অথবা 'কুজ্ঝটিকা' ধরনের একটা বিদঘুটে  বানান লিখতে বলবে মাটি তে। যতক্ষণ না তুমি ঠিক বানানটা  লিখছ, ততক্ষণ ছুটি নেই। বিকেল হবে, হাফ প্যান্ট পরা পায়ে মশা কামড়াবে, মাথার ওপর কালো বাদলের মত মশা আর পোকামাকড়ের ঝাঁক পিন পিন করে গান গাইবে, দুরের অসত্থ গাছের মাথায় বেম্মদত্তি নামবে, বটগাছের নিচে পেলু ময়রার দই এর মত অন্ধকার জমবে, আর তাতে না জানে কেনারা হাউ মাউ করে নিজেদের মুন্ডু হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। ভাইপোর প্রাণদীপ যে প্রায় ক্ষীণ হয়ে এসেছে সেসব দিকে আর কাকাবাবুর কোনো খেয়াল নেই। খেয়াল হবে কেন? এর পর তো শিবতলাতে এই নিয়ে তার মৌতাত জমবে বন্ধুদের সাথে। 

বানান না ঠিক করলে রেহাই নেই। 

তারপর যখন মশার কামড়ে নিজেরই নাজেহাল অবস্থা, অথবা আমাদের মুর্খতা দেখে নিতান্ত ক্লান্ত, তখন সঠিক উত্তরটা না দিয়েই হয়ত সে চলে  যাবে আপন খেয়ালে।  নাও, এবার ওই বটতলা পার কর চোখ বন্ধ করে। কথায়  আছে,প্রানে টান পড়লে বন্ধু সখা বলে কেউ থাকে না।  যে যার নিজের।  

আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে বট গাছ এর সীমানা অবধি পৌছাতাম। আমি, মানা, ক্ষুদিরাম, ফড়িং, মহেশ আর নাদীম, ভাবখানা এই যে কেউ কারো হাত ছাড়ব না। শাকচুন্নি বা সদ্দ্য মৃত এলাচ দাদুর ভূত, যেই আসুক না কেন! কিন্তু গাছ তলাতে আসলেই সকলের সব প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় উড়ে যেত। একটা বেয়াড়া তক্ষক আয়াজ দিলেই হল। দম বন্ধ করে পড়ি কি মরি সে কি দৌড় তখন আমাদের। বেশ পাঁচ মিনিট দৌড়াবার পর, সামনে শিবমন্দিরের পাশে এসে সবাই মেথরদার কুকুরদের মত হাঁফাতাম। দম নিতাম সস্তির। মুখে চোখে তখন আমাদের হাসি। এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছি। শিব ঠাকুর এর কাছে ভূত প্রেত  চালাকি করতে পারবে না বাবা। হুহ হুহ।

কিন্তু তাতেও রক্ষে নেই। খানিক্ষণের মধ্যেই সেই কাকুটা হয়ত সারা পাড়ায় রাষ্ট্র করে দিয়েছে আমরা দুপুর থেকে গুলি খেলছি বাঁশ বাগানে। নিজের টর্চার টা অবশ্য দিব্বি চেপে যেত।  

ঘরের কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেতাম মা দাড়িয়ে আছে দরজায়, মুখটা আমসত্তের মত করে। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতাম, বুকটা দুরু দুরু। ছোট বোন আর বাকি প্রতিবেশীর কচি কাঁচারা তখন বেশ চিড়িয়াখানার বাঁদর দেখার মত করে আমায় দেখে গেছে। সবাই এখন ভিড় করে আমাদের পড়ার ঘরের বাইরে দাড়িয়ে। এক চোখে আমায় দেখছে আর আরেকটা চোখ আমাদের শোবার ঘরের দরজায়। বাবা এক ঘন্টা আগে অফিস থেকে এসেছে।    

বাবা গম্ভীর মুখে বাইরে বেরোতেই মা আমার দিকে আঙুল  তুলে দেখিয়ে দিত, "ওই যে।" 
উফ! কি খুনে মা! 
তারপর আন্দাজ করে নাও।  

মায়েরা বোধহয় একটু অদ্ভূত মানুষ। মা আমায় বাবার হাতে অনায়াসে তুলে দিয়েই খান্ত হত না, বাবাকে দিব্বি উত্সাহ দিত আমাকে আরো কষে দুঘা দেবার জন্য। আবার সেই মাকেই দেখতাম, আঁচলে চোখ মুছতে। হারিকেনের কাঁচে কাপড় রেখে পীঠে সেঁক দিত, আমি ব্যথার জায়গাটা দেখিয়ে দিতাম হাত দিয়ে। 

গায়ের ব্যথাটা শেষ হবার সাথেই আবার সব ভুলে যেতাম। বুঝতেই পারছ আমার চামড়াটা এত মোটা কেন। 

আবার সেই ইস্কুল পালানো, আবার সেই বাঁশতলা, আবার সেই পীঠে পার্বন।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তোমাদের জন্য মেমসাহেব, সাহেব।

ইংরেজিতে লিখব না বাংলা? এই ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে গেল, লেখা আর হয়ে উঠল না। কোন কিছু শুরু করার আগে উদ্দেশ্যটা ঠিক হওয়া জরুরি। আমার প্রস্তুতি ঠিক ছিল না।  এখন ভাবছি লেখাটা জরুরি, ভাষাটা নয়। আমি যেহেতু দুটো ভাষা জানি, আমি দুটোতেই লিখব। যেটা বাংলায় লিখলে ভাল হয়, সেটা বাংলায় লিখব, যেটা ইংরেজিতে স্বাভাবিক, সেটা ইংরেজিতে লিখব। বাংলায় লিখতে পারলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই আমার মাতৃভাষা, কিন্তু ইংরেজি সহজতর। সেটা হয়ত আমার দুই দশকের ইংরেজি লিখে কাজ করার ফল।  আমি দুটি ভাষাতেই সাহিত্যমানের লেখা লিখতে পারব না। কিন্তু লিখতে ভালবাসি। সব  শেষে একটি ইবুক বানিয়ে আমাজনে বা গুগুলে ছেড়ে দেবো। সেটা অবশ্য এই চাকরিটা ছাড়ার পরেই সম্ভব। যখন সময় আসবে, তখন আমার লেখাগুলি এই বিশাল আন্তরজালে ঠাই পাবে। তার আগে লেখাগুলি তৈরি করা দরকার। কেউ পড়বে না হয়ত, কিন্তু আমার কন্যা শ্রাবস্তি আর ভাগ্নে প্রভেক পড়লেই যথেষ্ট। আমি যখন থাকব না, এই লেখাগুলি হয়ত ওদের একটু শান্তি দেবে। অমরত্বের ইচ্ছে আমার নেই, তবে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কথা বলতে পারার লোভ সংবরণ করা কঠিন।  হয়ত এই হাবিজাবি লেখাগুলি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ পড়ব...

বাংলা ও বাঙালি

বাংলায় লিখবো কি লিখবো না, পারব কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে ইংরেজিতে লেখা শুরু করলাম। তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।  শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউব চ্যানেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একটি লেকচার শুনলাম। কত মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফল আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমার মনে একটি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, আমার ভাষা বোধকরি সাহিত্য-উপযোগী নয়। তাহলে সাহিত্য সৃষ্টি করব কী করে। ওনার বক্তৃতা শুনে বুঝলাম এটি আমার মনের অযথা বাধা, এতে কোনও সার নেই। এই স্বরোপিত বাধা শুধু মায়ার খেলা। কত মানুষের কত রকম বাংলা। আজ যে ভাষায় লিখছি বা কথা বলছি, সেটিই কি খাঁটি? আমি যে ভাষায় লিখব সেটিই আমার ভাষা। এত ভাববার কি আছে। তাই, আমার জানা ভাষাতেই আমি আমার মতো করে সাহিত্য রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবটাই হাতে লিখবো আগে। পরে টাইপ করে নেওয়া যাবে, যেমন এখন করছি। আর হ্যাঁ, নিজের ভাষায় লিখছি, নিজের সাথে কথা বলার মতো করেই। সেখানে তাড়াহুড়ো চলবে না। যখন ইচ্ছে হবে লিখব, ইচ্ছে না হলে লিখব না। তবে লেখা থামাবো না। লেখটা শুরু করেছিলাম একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলে। সেটায় আসা  যাক। ভাদুড়ী মশাই তার...

হাবিজাবি ১

আমার এ লেখা কারোর উদ্দেশ্যে নয়, মহান সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও নয়, বাজে বইয়ের ভূমিকাও নয়। আমার এ লেখা শুধুমাত্র আমার জন্য। ছোটবেলায় যে পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। আমার পৃথিবী সবুজ ছিল। কচি পাতার সবুজ, পায়ের নরম সবুজ, পুকুরের ঘন সবুজ।  সেই সবুজ এখন আর দেখতে পাই না। হয়ত এখনও সেরকমই সবুজ পৃথিবী, শুধু আমি বুঝি দেখার চোখ হারিয়েছি, মনের সবুজ কালো হয়ে গেছে। সেই কালো ঘষে  মেজে আবার সবুজ করা যায় না? দেখি চেষ্টা করে।  বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে, যেকোনো ভাষাতেই লিখতে গেলে, সেটা  ভালো করে জানতে হয়। সেই ভাষায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা আর করা হয়না আগের মত। তাই ভাষার প্রতি দক্ষতাও হারিয়েছি। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে, তা নিজের ভাষায় নিজের মতই বলব। আত্মম্ভিরতার সুযোগ নেই এখানে, আমার জীবনে প্রাপ্তি খুব বেশি নেই, বা হয়ত আছে অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু হরে দরে দেখতে গেলে সবি শূন্যের খাতায় সই। ঠিক যেমন আমার প্রথম চাকরিতে খাতায় সই করে পাকানো কাগজে মাস-মাইনে পাওয়া।  বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ। ফারনান্দ পেশোয়ার সখ ছিল লেখা। এখন যত  অন্তর্ম...