বঙ্কু ও তার লাথি
কেলিয়ে কাঁঠাল পাকায় কি করে জানিনে, তবে বঙ্কু একবার একটা উটকো লোককে কেলিয়ে চাতাল ফাটিয়েছিল মনে আছে।
আমি তখন সবে বারো ক্লাসে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠেছি। বাবা কে বলেছিলাম আর্টস নিয়ে পড়ব । আমার রাশভারী বাবা তাতে এমনই দুঃখিত হলেন যে বাড়িতে মুরগি আনা বন্ধ করে দিলেন। নিজে সেদ্ধ খান, আমাদেরও রুটিন করে সেদ্ধ গেলাতে লাগলেন। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। অগত্যা সায়েন্স নিয়ে মুরগির ফ্লও এন্সিউর করলাম।
কিন্তু ঝাড়টা খেলাম মাইক্রো লেভেলে । জলের সাথে সালফিউরিক অ্যাসিড মেশালে সেটা কোকা-কোলা হয় না ইনোর মত অখাদ্য কিছু , তাতে আমার কোন উৎসাহ ছিলনা। ব্যাঙের পেটে কি আছে তা তো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি। উপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে গেলে কি সুন্দর 'ফটাস' করে আওয়াজ করে। জিভ বের করে থাকা প্রাণীটাকে কাঠি দিয়ে উলটে দেখ না কি দেখার আছে। তার জন্য আবার পড়াশোনা করার কি দরকার। আবার ল্যাব!!! বাড়াবাড়ির একশা মাইরি।
ফিজিক্স-এ নিউটনের তিনটি নিয়ম স্কুলের সব ছেলেই জানে মারামারি করার সময়। আমাদের বিশেষত কেউ গায়ে হাত দিলে তৃতীয় নিয়মটি ত হাতেনাতে পাওয়া যায়। বরঞ্চ যত্ন এবং দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়। ফর্মুলাটি ভুল, "প্রতি ক্রিয়ার তৎক্ষণাৎ এবং ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়" -- কার সাথে লাগছ সেটা না বুঝলে। এমত আমি বিজ্ঞান নিয়ে নতুন কি শিখব? তবু পড়তে হল।
আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিন যেমন পুশ সেল করতাম, তেমনি মাস্টারমশাইরা আমায় পুশপাস করালেন। ২৭ এর উত্তর দিয়ে মানুষ কি করে ৩১ পায়, তাও অঙ্কতে ...এটা আমার এখনো বোধগম্য হয়নি। এগার থেকে উঠলুম বারোতে।
যা হোক, যেমন আমার স্বভাব, তেমনি আমার সাঙ্গপাঙ্গ। আমাদের, মানে বিড়ি একাদশকে চেনে না এমন প্রাণী পাওয়া তখন দুষ্কর। যেখান দিয়েই আমরা যাই , সেখানেই চিনহ রেখে আসি। আমাদের হাতে চাঁদার বিল দেখলেই লোকে পকেটে হাত দেয়। কোন ঝঞ্ঝাট নেই। এক দুজন ঝামেলা করত বটে ... কিন্তু পরদিন আবার নিজেরা ক্লাবে এসে চাঁদা দিয়ে যেত। চোখের কোলে সারা রাত জাগার ক্লান্তি। জীবনটা বেশ মধুময় ছিল। মাইনাস বিজ্ঞান পড়া।
বিড়ি একাদশের জনা সাতেক, বিড়ি সপ্তদশ, বেশ ফন্দি করে এক সাথে ইংরেজি কোচিং যেতাম। সাতজনাই এক ব্যাচ। রাত দশটায় শেষ হত আমাদের 'পড়াশোনা'।
সেবার ছিল বর্ষাকাল ... কবিগুরু থাকলে নির্ঘাত কবিতা লিখে ফেলতেন, তেমনি গুরু গুরু ঘন মেঘ বর্ষণ বারি, ইত্যাদি। মানে ওল্ড মঙ্ক থামস আপ খাবার দিন। অবশ্যই সাথে বিড়ি। আমাদের ওখানে ব্যাঙে পেচ্ছাপ করলেও কারেন্ট যায় , আর এত একেবারে প্লাবন।
রাত দশটার পরেও দিব্বি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিটা একটু থামতেই এগারটা নাগাদ আমরা সাতজন নেবে পড়লাম রাস্তায়। রাস্তা তো নয়, যেন বম্মপুত্তর নদী। কোথায় নালা আর কোথায় চলার পথ , কিছুই বোঝা যায় না। আবার সেই দিন বঙ্কু খেয়েছে কানমলা মাস্টারমশাই এর হাতে।
স্যার কে তো আর কিছু করা যায় না, তাই আমরা ঠিক করলাম রাগটা অন্যের উপর দিয়েই ঝাড়ব। সামনে যেই আসবে এত রাত্তিরে, তাকে ভুগতে হবে। এহেন মন্ত্রে উদ্ভাসিত প্রাণ হয়ে আমরা সাতজন জলের মধ্যে দিয়ে পা টেনে টেনে চললাম।
খানিক বাদেই দেখতে পেলাম আমাদের প্রথম শিকার। একটা লোক, একটু ঝুকে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। আমরা যে যার পজিসান নিয়ে নিলাম। যেহেতু বঙ্কু খেয়েছে মার, তাই তার অধিকার প্রথম থাবায়।
লোকটা পা মেপে মেপে এগিয়ে আসছিল, ঘুট ঘুটে অন্ধকার, দু হাত দুরের জিনিশ ভাল করে বোঝা যায় না। কাছে আসতে বোঝা গেল লোকটা মাঝবয়সী এবং দুটি ছাতা ধরে। একটা মাথার ওপর খাটানো, অন্যটি হাথে ঝোলান। দেখেই মটকাটা গরম হয়ে গেল। কত লক ছাতা না পেয়ে মারা যাচ্ছে, দেশের কত বেকার মাথার ওপর ছাতা পেলে একটা জুতো সারাইয়ের দোকান খুলে বসতে পারে। আমরা ভিজে কাক আর এই লোকটা কিনা এই দুর্যোগের দিনে একটা ছাতা এমনি এমনি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? দুনিয়ার সব ছত্রিধারিদের ওপর এক প্রচণ্ড রাগে আমাদের প্রতিবাদী মন বিদ্রোহ করে উঠল।
বঙ্কু আবার কিছু দিন কারাটে শিখেছিল একেবারে ছোটবেলায়। ইশকুলে সে সব জাহির করতে গিয়ে বাঙ্গালি ঘুসি খেয়েছে বার কতক। তাই তেমন করে পরখ করা হয়নি নিজের বিদ্যে কোনদিনই। কারাটে শিখে যদি সেটা জাহিরই না করা গেল, তাহলে আর কি লাভ। লোকটাকে পাশে আসতে দিল বঙ্কু । শ্বাস চেপে এক, দুই, তিন ... একটা ফ্লাইং কিক! যেন এক ঝলক বিদ্যুৎ। লোকটা 'বাবা রে' বলে পাশে ডুবে যাওয়া ড্রেনে আরও ডুবে গেল।
আমরা যথারীতি দৌড় মারলাম যে যেদিকে পারি। একটু এগিয়ে আমাদের মীটিং পয়েন্টে আবার একত্রিত হলাম। বঙ্কু তখন ব্যাস্ত তার লাথির মাহাত্ম্য বোঝাতে। ওর দাবি ব্রুস লির পর আর ওরকম লাথি সম্ভব হয়নি । "ব্রুস লি টু বঙ্কু শি," অমল বঙ্কুর পা তুলে ধরল। বঙ্কু জলে পড়ে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ল অজয়ের দিকে।
রাত অনেক হয়েছিল, তাই ভাবলাম আর এডভেঞ্চার করে লাভ নেই, মা রান্নাঘর তালা দিয়ে শুয়ে পড়বে । বাড়ী যাওয়া যাক। বঙ্কুর বাড়ী সামনেই । আমরা দল বেঁধে ওকে ছাড়তে গেলাম। কাকু-কাকিমা আমাদের খুব ভালবাসেন। প্রায় নিজের ছেলের মতই। বলতে গেলে ওরাই বোধয় একমাত্র মানুষ এই পৃথিবীতে যারা আমাদের ভালবাসে। আমাদের নিজেদের বাবা-মায়েদের আফসোসের শেষ নেই। বাবা আমার মামার বাড়ীর জিন , আর মা বাবার ছোটলোকের রক্তকেই দায়ী করে আমার জন্য। বাকিদের অবস্থাও মোটামুটি তাই। কিন্তু বঙ্কুর বাড়িতে গেলেই একটা রাজভোগ বাঁধা , সে তুমি যত রাতেই যাও না কেন।
আমরা গিয়ে হই-হল্লা করতে লাগলাম... "কাকিমা... কাকু... বঙ্কুকে দিতে এলাম।"
কাকিমা বেরিয়ে এলেন, চিন্তিত মুখ, "হাঁরে... তোদের কাকু তো দুটো ছাতা নিয়ে বঙ্কুকে নিতে গেলেন, তোরা রাস্তায় দেখতে পাসনি? এখনো তো এলেন না, আধ ঘণ্টা হয়ে গেলো। ওদিকে তোরাও চলে এলি।
অমলটা বরাবরই গানডু , মুখ ফসকে বলেই ফেললো, "হ্যাঁ দেখেছি তো, ওহ তাহলে ওই লোকটা..." বঙ্কু রে রে করে উঠল। অমলকে চুপ করতে হল।
আমরা কাকু কে যে জায়গায় রেখে এসেছিলাম উনি সেখানেই শ্রীচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। আমরা উদ্ধার করতেই হাউমাউ করে উঠলেন। অনেক চেঁচামেচি করার পর বললেন, "বাঁচালে বাবা, ওরা ত আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, বেজন্মার ছেলে লাথি মারল বাপের বয়সী লোককে, এহ...এহ? খুনে খুনে... ওরা সব খুনে। বেজন্মা..., বিষবৃক্ষ।" উনি তড়পাচ্ছিলেন। "চলো বাড়ী চল, তোমরা আমায় নতুন প্রাণ দিলে, চলো একটু মিষ্টিমুখ কর।"
আমরা আবার বঙ্কুর বাড়ীর দিকে মুখ ফেরালাম। বঙ্কু খেঁকখেঁক করে উঠল, "না, ওরা যাবে না।" তারপর আমাদের দিকে যা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল না, আমাদের মিষ্টি আর মাস খানেক যে কপালে নেই, সেটা বেশ বোঝা গেল।
বছর তিনেক আগে বঙ্কুর বাবা মারা গেলেন। তিনি অনেক দিন ধরেই মরব মরব করছিলেন কিন্তু কিছুতেই শেষ হাওয়া ফুঁকছিলেন না। ওদিকে বঙ্কুর ঝিঙ্কির সাথে বিয়ে হচ্ছে না, বঙ্কুর নিজের কোনও রোজগার নেই বলে। বঙ্কুর মিষ্টির দোকানে বসতে ভাল লাগে না। ওদিকে ওর বাবা একমাত্র ছেলে দোকানে না বসলে একটা টাকা ছোঁয়াবে না বলে দিয়েছে। বাবাকে তো সবাই ভালবাসে, জাহাঙ্গীরও আকবর বাদশাহকে খুব ভালবাসত।
বঙ্কু যখনই মনে মনে তৈরি হয়ে যায় সপ্তাহ খানেক মালসায় খাবার জন্য, তখনই ওর বাবা বলে ওঠেন, "আজ বেশ ভাল লাগছে রে বঙ্কু।"
এরকম করে মাস তিনেক গেল। বঙ্কু ততদিনে কার্ড সব ছাপিয়ে ফেলেছে। প্রত্যেক মাসেই এক সেট করে কার্ড ছাপায়। "অতীব দুঃখের সাথে জানাই আমার পিতৃদেবের গঙ্গাপ্রাপ্তি ..." ইত্যাদি। সব শেষে "অভাগা বঙ্কুবিহারি শি"। দিন ও সময়ের জায়গাটা খালি।
এভাবে তিন সেট কার্ড নষ্ট হল। শেষে থাকতে না পেরে, মাসের একত্রিশ তারিখে, বঙ্কু বাপের কাছে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল। "বাবা তোমায় একটা কথা বলার ছিল"
"বল না," উনি উঠে বসলেন।
"না বাবা তোমার খারাপ লাগবে," বঙ্কু কিন্তু কিন্তু করে।
"বলনা বাবা... এখন তো আমি ভাল হয়ে গেছি," কাকুর কণ্ঠে নবযৌবন।
বঙ্কু ভারি হতাশ হল। কথাটা পেড়েই ফেলল। কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, "বাবা সেদিন লাথিটা আমিই তোমায় মেরেছিলাম..."
শুনেছি কাকুর মরণ আর্তনাদ নাকি পরের ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকাল ট্রেনের যাত্রিরাও শুনে ঘাবড়ে গেছিল।
কেলিয়ে কাঁঠাল পাকায় কি করে জানিনে, তবে বঙ্কু একবার একটা উটকো লোককে কেলিয়ে চাতাল ফাটিয়েছিল মনে আছে।
আমি তখন সবে বারো ক্লাসে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠেছি। বাবা কে বলেছিলাম আর্টস নিয়ে পড়ব । আমার রাশভারী বাবা তাতে এমনই দুঃখিত হলেন যে বাড়িতে মুরগি আনা বন্ধ করে দিলেন। নিজে সেদ্ধ খান, আমাদেরও রুটিন করে সেদ্ধ গেলাতে লাগলেন। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। অগত্যা সায়েন্স নিয়ে মুরগির ফ্লও এন্সিউর করলাম।
কিন্তু ঝাড়টা খেলাম মাইক্রো লেভেলে । জলের সাথে সালফিউরিক অ্যাসিড মেশালে সেটা কোকা-কোলা হয় না ইনোর মত অখাদ্য কিছু , তাতে আমার কোন উৎসাহ ছিলনা। ব্যাঙের পেটে কি আছে তা তো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি। উপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে গেলে কি সুন্দর 'ফটাস' করে আওয়াজ করে। জিভ বের করে থাকা প্রাণীটাকে কাঠি দিয়ে উলটে দেখ না কি দেখার আছে। তার জন্য আবার পড়াশোনা করার কি দরকার। আবার ল্যাব!!! বাড়াবাড়ির একশা মাইরি।
ফিজিক্স-এ নিউটনের তিনটি নিয়ম স্কুলের সব ছেলেই জানে মারামারি করার সময়। আমাদের বিশেষত কেউ গায়ে হাত দিলে তৃতীয় নিয়মটি ত হাতেনাতে পাওয়া যায়। বরঞ্চ যত্ন এবং দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়। ফর্মুলাটি ভুল, "প্রতি ক্রিয়ার তৎক্ষণাৎ এবং ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়" -- কার সাথে লাগছ সেটা না বুঝলে। এমত আমি বিজ্ঞান নিয়ে নতুন কি শিখব? তবু পড়তে হল।
আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিন যেমন পুশ সেল করতাম, তেমনি মাস্টারমশাইরা আমায় পুশপাস করালেন। ২৭ এর উত্তর দিয়ে মানুষ কি করে ৩১ পায়, তাও অঙ্কতে ...এটা আমার এখনো বোধগম্য হয়নি। এগার থেকে উঠলুম বারোতে।
যা হোক, যেমন আমার স্বভাব, তেমনি আমার সাঙ্গপাঙ্গ। আমাদের, মানে বিড়ি একাদশকে চেনে না এমন প্রাণী পাওয়া তখন দুষ্কর। যেখান দিয়েই আমরা যাই , সেখানেই চিনহ রেখে আসি। আমাদের হাতে চাঁদার বিল দেখলেই লোকে পকেটে হাত দেয়। কোন ঝঞ্ঝাট নেই। এক দুজন ঝামেলা করত বটে ... কিন্তু পরদিন আবার নিজেরা ক্লাবে এসে চাঁদা দিয়ে যেত। চোখের কোলে সারা রাত জাগার ক্লান্তি। জীবনটা বেশ মধুময় ছিল। মাইনাস বিজ্ঞান পড়া।
বিড়ি একাদশের জনা সাতেক, বিড়ি সপ্তদশ, বেশ ফন্দি করে এক সাথে ইংরেজি কোচিং যেতাম। সাতজনাই এক ব্যাচ। রাত দশটায় শেষ হত আমাদের 'পড়াশোনা'।
সেবার ছিল বর্ষাকাল ... কবিগুরু থাকলে নির্ঘাত কবিতা লিখে ফেলতেন, তেমনি গুরু গুরু ঘন মেঘ বর্ষণ বারি, ইত্যাদি। মানে ওল্ড মঙ্ক থামস আপ খাবার দিন। অবশ্যই সাথে বিড়ি। আমাদের ওখানে ব্যাঙে পেচ্ছাপ করলেও কারেন্ট যায় , আর এত একেবারে প্লাবন।
রাত দশটার পরেও দিব্বি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিটা একটু থামতেই এগারটা নাগাদ আমরা সাতজন নেবে পড়লাম রাস্তায়। রাস্তা তো নয়, যেন বম্মপুত্তর নদী। কোথায় নালা আর কোথায় চলার পথ , কিছুই বোঝা যায় না। আবার সেই দিন বঙ্কু খেয়েছে কানমলা মাস্টারমশাই এর হাতে।
স্যার কে তো আর কিছু করা যায় না, তাই আমরা ঠিক করলাম রাগটা অন্যের উপর দিয়েই ঝাড়ব। সামনে যেই আসবে এত রাত্তিরে, তাকে ভুগতে হবে। এহেন মন্ত্রে উদ্ভাসিত প্রাণ হয়ে আমরা সাতজন জলের মধ্যে দিয়ে পা টেনে টেনে চললাম।
খানিক বাদেই দেখতে পেলাম আমাদের প্রথম শিকার। একটা লোক, একটু ঝুকে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। আমরা যে যার পজিসান নিয়ে নিলাম। যেহেতু বঙ্কু খেয়েছে মার, তাই তার অধিকার প্রথম থাবায়।
লোকটা পা মেপে মেপে এগিয়ে আসছিল, ঘুট ঘুটে অন্ধকার, দু হাত দুরের জিনিশ ভাল করে বোঝা যায় না। কাছে আসতে বোঝা গেল লোকটা মাঝবয়সী এবং দুটি ছাতা ধরে। একটা মাথার ওপর খাটানো, অন্যটি হাথে ঝোলান। দেখেই মটকাটা গরম হয়ে গেল। কত লক ছাতা না পেয়ে মারা যাচ্ছে, দেশের কত বেকার মাথার ওপর ছাতা পেলে একটা জুতো সারাইয়ের দোকান খুলে বসতে পারে। আমরা ভিজে কাক আর এই লোকটা কিনা এই দুর্যোগের দিনে একটা ছাতা এমনি এমনি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? দুনিয়ার সব ছত্রিধারিদের ওপর এক প্রচণ্ড রাগে আমাদের প্রতিবাদী মন বিদ্রোহ করে উঠল।
বঙ্কু আবার কিছু দিন কারাটে শিখেছিল একেবারে ছোটবেলায়। ইশকুলে সে সব জাহির করতে গিয়ে বাঙ্গালি ঘুসি খেয়েছে বার কতক। তাই তেমন করে পরখ করা হয়নি নিজের বিদ্যে কোনদিনই। কারাটে শিখে যদি সেটা জাহিরই না করা গেল, তাহলে আর কি লাভ। লোকটাকে পাশে আসতে দিল বঙ্কু । শ্বাস চেপে এক, দুই, তিন ... একটা ফ্লাইং কিক! যেন এক ঝলক বিদ্যুৎ। লোকটা 'বাবা রে' বলে পাশে ডুবে যাওয়া ড্রেনে আরও ডুবে গেল।
আমরা যথারীতি দৌড় মারলাম যে যেদিকে পারি। একটু এগিয়ে আমাদের মীটিং পয়েন্টে আবার একত্রিত হলাম। বঙ্কু তখন ব্যাস্ত তার লাথির মাহাত্ম্য বোঝাতে। ওর দাবি ব্রুস লির পর আর ওরকম লাথি সম্ভব হয়নি । "ব্রুস লি টু বঙ্কু শি," অমল বঙ্কুর পা তুলে ধরল। বঙ্কু জলে পড়ে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ল অজয়ের দিকে।
রাত অনেক হয়েছিল, তাই ভাবলাম আর এডভেঞ্চার করে লাভ নেই, মা রান্নাঘর তালা দিয়ে শুয়ে পড়বে । বাড়ী যাওয়া যাক। বঙ্কুর বাড়ী সামনেই । আমরা দল বেঁধে ওকে ছাড়তে গেলাম। কাকু-কাকিমা আমাদের খুব ভালবাসেন। প্রায় নিজের ছেলের মতই। বলতে গেলে ওরাই বোধয় একমাত্র মানুষ এই পৃথিবীতে যারা আমাদের ভালবাসে। আমাদের নিজেদের বাবা-মায়েদের আফসোসের শেষ নেই। বাবা আমার মামার বাড়ীর জিন , আর মা বাবার ছোটলোকের রক্তকেই দায়ী করে আমার জন্য। বাকিদের অবস্থাও মোটামুটি তাই। কিন্তু বঙ্কুর বাড়িতে গেলেই একটা রাজভোগ বাঁধা , সে তুমি যত রাতেই যাও না কেন।
আমরা গিয়ে হই-হল্লা করতে লাগলাম... "কাকিমা... কাকু... বঙ্কুকে দিতে এলাম।"
কাকিমা বেরিয়ে এলেন, চিন্তিত মুখ, "হাঁরে... তোদের কাকু তো দুটো ছাতা নিয়ে বঙ্কুকে নিতে গেলেন, তোরা রাস্তায় দেখতে পাসনি? এখনো তো এলেন না, আধ ঘণ্টা হয়ে গেলো। ওদিকে তোরাও চলে এলি।
অমলটা বরাবরই গানডু , মুখ ফসকে বলেই ফেললো, "হ্যাঁ দেখেছি তো, ওহ তাহলে ওই লোকটা..." বঙ্কু রে রে করে উঠল। অমলকে চুপ করতে হল।
আমরা কাকু কে যে জায়গায় রেখে এসেছিলাম উনি সেখানেই শ্রীচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। আমরা উদ্ধার করতেই হাউমাউ করে উঠলেন। অনেক চেঁচামেচি করার পর বললেন, "বাঁচালে বাবা, ওরা ত আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, বেজন্মার ছেলে লাথি মারল বাপের বয়সী লোককে, এহ...এহ? খুনে খুনে... ওরা সব খুনে। বেজন্মা..., বিষবৃক্ষ।" উনি তড়পাচ্ছিলেন। "চলো বাড়ী চল, তোমরা আমায় নতুন প্রাণ দিলে, চলো একটু মিষ্টিমুখ কর।"
আমরা আবার বঙ্কুর বাড়ীর দিকে মুখ ফেরালাম। বঙ্কু খেঁকখেঁক করে উঠল, "না, ওরা যাবে না।" তারপর আমাদের দিকে যা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল না, আমাদের মিষ্টি আর মাস খানেক যে কপালে নেই, সেটা বেশ বোঝা গেল।
বছর তিনেক আগে বঙ্কুর বাবা মারা গেলেন। তিনি অনেক দিন ধরেই মরব মরব করছিলেন কিন্তু কিছুতেই শেষ হাওয়া ফুঁকছিলেন না। ওদিকে বঙ্কুর ঝিঙ্কির সাথে বিয়ে হচ্ছে না, বঙ্কুর নিজের কোনও রোজগার নেই বলে। বঙ্কুর মিষ্টির দোকানে বসতে ভাল লাগে না। ওদিকে ওর বাবা একমাত্র ছেলে দোকানে না বসলে একটা টাকা ছোঁয়াবে না বলে দিয়েছে। বাবাকে তো সবাই ভালবাসে, জাহাঙ্গীরও আকবর বাদশাহকে খুব ভালবাসত।
বঙ্কু যখনই মনে মনে তৈরি হয়ে যায় সপ্তাহ খানেক মালসায় খাবার জন্য, তখনই ওর বাবা বলে ওঠেন, "আজ বেশ ভাল লাগছে রে বঙ্কু।"
এরকম করে মাস তিনেক গেল। বঙ্কু ততদিনে কার্ড সব ছাপিয়ে ফেলেছে। প্রত্যেক মাসেই এক সেট করে কার্ড ছাপায়। "অতীব দুঃখের সাথে জানাই আমার পিতৃদেবের গঙ্গাপ্রাপ্তি ..." ইত্যাদি। সব শেষে "অভাগা বঙ্কুবিহারি শি"। দিন ও সময়ের জায়গাটা খালি।
এভাবে তিন সেট কার্ড নষ্ট হল। শেষে থাকতে না পেরে, মাসের একত্রিশ তারিখে, বঙ্কু বাপের কাছে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল। "বাবা তোমায় একটা কথা বলার ছিল"
"বল না," উনি উঠে বসলেন।
"না বাবা তোমার খারাপ লাগবে," বঙ্কু কিন্তু কিন্তু করে।
"বলনা বাবা... এখন তো আমি ভাল হয়ে গেছি," কাকুর কণ্ঠে নবযৌবন।
বঙ্কু ভারি হতাশ হল। কথাটা পেড়েই ফেলল। কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, "বাবা সেদিন লাথিটা আমিই তোমায় মেরেছিলাম..."
শুনেছি কাকুর মরণ আর্তনাদ নাকি পরের ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকাল ট্রেনের যাত্রিরাও শুনে ঘাবড়ে গেছিল।
মন্তব্যসমূহ
jodio bonku-ke hat-er kacche pele hebby kyalatam! :)
aar amar lekhar iccha holei likhbo, seta dine teenbaro hote pare aabar teen mashe ekbaro hote pare. tumi kintu porte theko.
shesher dikta edit korle eta fact-i bote.
tridib-da,
janab...shukriya. sharodiyar ta sharodiya tei hobe.
fool-da aar tridib-da nirobe haschen. ki aar kora jay?
Ghetubabu, apnar self-appointed editor hishebey arekbar dhoriye dilam...ota bodhoy "ochoitonyo" hobey, taina? :-)
ota 'choitonyo' e hobe. mane, duhat tule pore chilen. eibar aapni ektu bhul korechen, jodio protibar lajjata aapni-e bachiyechen.
dhonyobad.
prothomoto amake aapni bolben naa,
dwitiyoto, tipponi ta na dilei bodhoy bhalo hoto, aapnar jemon mone hoto, temoni interpret korten, shamanyo ek 'O', tate ki ashe jay.
aamra "to let" lekha dekhle majhkhane "i" boshiye ditam. ki aar gelo elo ekta 'i' te.
Bishesh kore... "27-er uttar diye manush ki kore 31 pay, tao onkote...eta aamr ekhono bodhogomyo
hoyni" :)
Shoti katha bolte ki seta amar-o bodhogomyo hoy ni...erokom amar shonge-o ekadhik baar hoyechhe....
Fatafati likhechhen...chaliye jaan...
Apnar onumoti'r opekkha na korei amar blog e apnar link lagachhi...
abar ashbo....apnio ashben...
Bishesh kore... "27-er uttar diye manush ki kore 31 pay, tao onkote...eta aamr ekhono bodhogomyo
hoyni" :)
Shoti katha bolte ki seta amar-o bodhogomyo hoy ni...erokom amar shonge-o ekadhik baar hoyechhe....
Fatafati likhechhen...chaliye jaan...
Apnar onumoti'r opekkha na korei amar blog e apnar link lagachhi...
abar ashbo....apnio ashben...